স্মার্ট বাংলাদেশের পথে

32

মোঃ তৌহিদুজ্জামান : স্মার্ট শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে যে শব্দদ্বয় আমাদের প্রথমেই মনে আসে তা হচ্ছে সুবেশ বা পরিচ্ছন্ন। তবে শব্দটির আরো অনেকগুলি বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে, যেমন- দক্ষ, চটপটে, তীক্ষèধি, বুদ্ধিমান ইত্যাদি। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে আমরা যে নতুন রূপকল্প পেয়েছি সেখানে দক্ষ, চটপটে, বুদ্ধিমান এ শব্দগুলোই স্মার্টকে নির্দেশ করে।

 

২০২২ সালে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখালেন তারও ১৪ বছর আগে তিনি অনুরূপ আরেকটি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা হচ্ছে ২০২১ সালের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। এদেশের মানুষ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দটি প্রথমবারের মতো শুনতে পায় ২০০৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণায়। এ ঘোষণার প্রথম কয়েক বছরে শব্দ দুটি অনেকেই বিদ্রুপ সুরেই উচ্চারণ করেছে। সে বিদ্রুপগুলো যে তাদের অজ্ঞতা প্রসূত ছিল, তা কয়েক বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।

 

সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো তো দূরের কথা, যারা অগ্রভাগে ছিলেন তারাও ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য অতি আবশ্যক বিদ্যুৎ সংযোগ ও সরবরাহ এবং ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির দুরবস্থা দেখে ডিজিটাল বাংলাদেশের অবয়ব কেমন হতে পারে, তা কল্পনায় আনতে পারেননি। কিন্তু ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আজ বাস্তবতা।

 

মানবসম্পদ উন্নয়ন, ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান , ই-প্রশাসন ও তথ্য প্রযুক্তি শিল্পখাত গড়ে তোলা- ডিজিটাল বাংলাদেশের এই চার স্তম্ভকে ঘিরে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে দেশে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। এর ফলে মানুষ সরকারি-বেসরকারি নানা সেবা যেমন ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছে তেমনিভাবে উদ্যোগগুলো দেশে-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক এলাকাটিতেও আজ ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে গেছে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে আজ মোবাইল গ্রাহক ১৮ কোটি ছাড়িয়েছে (অনেকে একাধিক সিম ব্যবহার করেন)। ইন্টারনেট গ্রাহকও পৌঁছে গেছে ১৩ কোটিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এখন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপক ভাবে। মানুষ নানাভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাভোগ করছে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে, করোনাকালীন জীবন-জীবিকার সমন্বয় সাধনে বাংলাদেশ আশপাশের বহু দেশ অপেক্ষা বেশি সাফল্য দেখিয়েছে।

 

ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ পরিক্রমায় বহুদূর অগ্রসর হয়ে গত বছর ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নতুন করে ঘোষণা দিলেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন, তা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ওই বক্তৃতাতেই তিনি স্মার্ট বাংলাদেশের অবয়ব তুলে ধরলেন। স্মার্ট বাংলাদেশে সবকিছু হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। সেখানে নাগরিকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, এর মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতি পরিচালিত হবে। সরকার ও সমাজকে স্মার্ট করে গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছে তা আরও প্রসারিত হবে।

 

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছিল বলতে গেলে একেবারে শূন্য থেকে কিন্তু স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা শূন্য থেকে নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশের পথকে শুধু মসৃণ করেনি বরং এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা অগ্রভাগে। স্মার্ট বাংলাদেশ ঘোষণার আগেই গতবছর ১৬ আগস্ট ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ৩০ সদস্যের টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান এবং তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের সচিব এর সদস্য সচিব। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনোমি এবং স্মার্ট গভার্ণমেণ্ট- ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ এ চারটি পিলার বাস্তবায়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা প্রদানকে টাস্কফোর্সের কার্যপরিধিভুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য যেসব বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান এ টাস্কফোর্সের কার্যপরিধিভুক্ত রয়েছে সেগুলি হচ্ছে, অগ্রসরমান প্রযুক্তির বাস্তবায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপন্তর, স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ,বাণিজ্যিক ও বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বিধিবিধান প্রণয়ন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-০২ উৎক্ষেপণ, এজেন্সি ফর নলেজ অন এরোনটিক্যাল এন্ড স্পেস হরাইজন প্রতিষ্ঠা, ব্লেন্ডেড এডুকেশন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, চতুর্থ সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ স্থাপন, রপ্তানির কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মেইড ইন বাংলাদেশ পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং আর্থিক খাতের ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়ন ।

 

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নির্বাহী কামিটি’র যে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের কার্যপরিধিভূক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে তাদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হচ্ছে-তথ্য প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্ট বিজনেস মডেল প্রণয়ন, বর্হিবিশ্বে আইসিটি খাতে ব্রান্ডিং, দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে অও, উরমরঃধষ ঝবপঁৎরঃু, ৪ওজ, ইরম উধঃধ, ইষড়পশ ঈযধরহ, জড়নড়ঃরপং, ওড়ঞ ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করা, ব্লেন্ডেড এডুকেশন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, ৫এ সেবা চালু, চতুর্থ সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ স্থাপন, গোপালগঞ্জে একটি আন্তর্জাতিক মানের ডাটা সেন্টার স্থাপন, টেলিকমিউনিকেশনের এডভান্স রিসার্চ ও ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন, ‘ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম’ এর আওতায় শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, এজেন্সি ফর নলেজ অন এরোনটিক্যাল এন্ড স্পেস হরাইজন প্রতিষ্ঠা, অল্টারনেটিভ স্কুল ফর স্টার্টআপ এডুকেশন অব টুমরো এবং সেন্টার ফর লার্নিং ইনোভেশন এণ্ড ক্রিয়েশন অব নলেজ প্রতিষ্ঠা, সকল ডিজিটাল সেবাকে সমন্বিত করে ক্লাউডের আওতায় আনা, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ যেন পারস্পরিক প্রয়োজনে তাদের ডাটা শেয়ার করতে পারে, সে লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন, ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ স্থাপন ইত্যাদি।

 

‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নির্বাহী কামিটি’র বিচক্ষণ ও সময়োপযোগী এ সিদ্ধান্তগুলো যে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনোমি এবং স্মার্ট গভার্ণমেণ্ট নামক ভিতগুলোকে সুদৃঢ় করবে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আর তারুণ্যের শক্তিতে ২০৪১ সালের আগেই এদেশ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপে বিশ্ববাসীর সামনে অবির্ভূত হবে এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।-লেখক,উপপ্রধান তথ্য অফিসার আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।

SHARE