স্টাফ রির্পোটার : রাজশাহীতে জমি নিয়ে ভয়াবহ প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। একই জমি চারবার বায়না রেজিস্ট্রির অভিযোগ উঠেছে। এর মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক নারী কাউন্সিলর ফারজানা হক।
এ প্রতারণায় তিন জনকে আটক করেছে রাজপাড়া থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ফারজানা হক, তার স্বামী রেজাউল করিম ও তোফায়েল। গ্রেপ্তারকৃতদের বৃহস্পতিবার আদালতের মাধ্যমে জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্তকারি অফিসার সাব-ইন্সপেক্টর সুবাস চন্দ্র বর্মন নিশ্চিত করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার রেজাউল ইসলামের স্ত্রীর এ প্রতারণায় প্রতারিতদের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা ফারজানার কাছে জমি রেজিস্ট্রি চাইছেন কিন্তু তিনি জমি রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছেন না, টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না।
প্রতারিতরা হলেন- মহানগরীর মোল্লাপাড়া এলাকার সাজ্জাদ বাদশা সূর্য্য, বহরমপুর এলাকার শফিকুল ইসলাম, আলীগঞ্জ এলাকার আব্দুল গাফ্ফার, বসুয়া এলাকার আব্দুল খালেক এবং বুলনপুরের মহিদুল হক। বায়না দলিল রেজিস্ট্রির মাধ্যমে সাবেক কাউন্সিলর ফারজানা হক চার দফায় ৯৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
তবে প্রতারিতদের দাবি, ফারজানা শুধু তাদের কাছেই নয়, আরও কয়েকজনের কাছে একই জমি দেখিয়ে বায়নার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
প্রতারিতরা জানান, গত বছরের ২৩ জুন মহানগরীর উপকণ্ঠ আলীগঞ্জ মৌজায় ফারজানার কাছ থেকে প্রথমে প্রতি কাঠা সাড়ে সাত লাখ টাকা দামে দুই কাঠা জমি বায়না দলিল করেন সূর্য্য। এ সময় বায়না বাবদ সূর্যের কাছ থেকে ফারজানা ১০ লাখ টাকা নেন। ৬ মাসের জন্য এ বায়না করা হয়। ৬ মাস পর আরও ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে সূর্যকে জমি রেজিস্ট্রি দেওয়ার কথা ফারজানার; কিন্তু ছয় মাস অতিবাহিত হলেও তিনি সূর্য্যকে জমি রেজিস্ট্রি দেননি।
সূর্য্যর সঙ্গে বায়না রেজিস্ট্রির দুই সপ্তাহ না পেরুতেই দ্বিতীয় বায়নাটি করেন ফারজানা। আলীগঞ্জ এলাকার আব্দুল গাফ্ফারের সঙ্গে ১০ কাঠা জমির মধ্যে পৌনে ৫ কাঠা জমির বায়না করা হয়। এ সময় প্রতি কাঠা জমির দাম নির্ধারিত হয় ৮ লাখ টাকা। মোট জমির দাম ছিল সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। বায়না বাবদ ফারজানা এ সময় গাফ্ফারের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন; কিন্তু ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও গাফ্ফারকে জমি রেজিস্ট্রি দিচ্ছেন না। এমনকি টাকাও ফেরত দেননি। এখন হয় জমি রেজিস্ট্রি, নতুবা টাকা ফেরতের জন্য ফারজানার পেছনে ঘুরছেন গাফ্ফার।
পরে ১৭ আগস্ট পূর্বের দুটি বায়না বাতিল না করেই অত্যন্ত গোপনে আরেকটি বায়না সম্পাদন করেন ফারজানা। ফারজানা এ সময় ১০ কাঠা জমির বিপরীতে মহানগরীর শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ৩৭ লাখ টাকা নেন। শফিকুলের কাছে প্রতি কাঠা জমির দাম ধরা হয় ৯ লাখ টাকা। এরপর প্রায় ছয় মাসের কাছাকাছি হলেও শফিকুলকে জমি রেজিস্ট্রি দেননি ফারজানা। এমনকি তার টাকা ফেরত দিতেও টালবাহানা শুরু করেছেন।
সর্বশেষ চতুর্থবার বায়না রেজিস্ট্রি নিয়ে ফারজানা প্রতারণা করেছেন গত ২৯ ডিসেম্বর। মহানগরীর বসুয়া এলাকার আব্দুল খালেক এবং কোর্ট বুলনপুর এলাকার মহিদুল হকের সঙ্গে এ প্রতারণা করেন তিনি। ফারজানা এ সময় অতি গোপনে বায়না রেজিস্ট্রি বাবদ এ দুজনের কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। প্রতি কাঠা জমির দাম ১১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অন্যদের মতো খালেক এবং মহিদুলের কাছে এ জমির পুরো টাকা নিয়ে ছয় মাস পরে রেজিস্ট্রি দেওয়ার কথা।
এদিকে ফারজানার প্রথম বায়নাকারী সূর্য্য বিষয়টি জানার পর তাকে টাকা ফেরত দিতে বলেন। এরপর বিষয়টি সূর্য্য তৃতীয় বায়নাকারী আব্দুল খালেক এবং মহিদুল হককে জানান। গত ২৬ জানুয়ারি বিকাল ৩টার দিকে পবা সাবরেজিস্ট্রার অফিসে যান ফারজানা। এ সময় বিষয়টি জানতে পেরেও সেখানে উপস্থিত হন প্রতারিতরা। তারা ফারজানাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন।
এ সময় প্রতারিতরা ফারজানাকে তাদের যেকোনো একজনকে জমি রেজিস্ট্রি দিতে বলেন। বাকি অন্যদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেন।
এ সময় প্রতারিতরা সিদ্ধান্ত নেন জমিটি আব্দুল খালেক এবং মহিদুল হকের নামে রেজিস্ট্রি হলে তাদের আপত্তি নেই। এ নিয়ে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সেখানে কথাবার্তা হয়। কিন্তু ফারাজানা কিছুতেই প্রতারিতদের টাকা ফিরত কিংবা জমি রেজিস্ট্রি দিতে চান না। পরবর্তীতে সবার চাপে তিনি জমিটি আব্দুল খালেক এবং মহিদুল হকের নামে রেজিস্ট্রি দিতে সম্মত হন।
এ ব্যাপারে প্রতারণার শিকার আব্দুল খালেক বলেন, আমি এবং আমার পার্টনার ফারজানার ১০ কাঠা জমি ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় নেওয়ার জন্য বায়না দলিল করেছি। বায়নার সময় তাকে ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। বাকি টাকা ৬ মাসের মধ্যেই তাকে বুঝিয়ে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে জানতে পারি ফারজানা অন্যদের কাছেও বায়না করে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। তিনি এভাবে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
খালেক বলেন, জমিটি আমি এবং আমার পার্টনারকে রেজিস্ট্রি দেওয়ার কথা। অন্য প্রতারিতরাও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, কিন্তু তিনি জমি রেজিস্ট্রি কিংবা বায়নার টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এর ফলে আমরা সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এ ঘটনায় আমরা আইনের আশ্রয় নেব।
আরেক প্রতারিত ব্যক্তি শফিকুল ইসলাম বলেন, ফারজানার প্রতারণার বিষয়টি আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। তিনি অত্যন্ত কৌশলে আমাদের প্রতারিত করেছেন। এখন শুনতে পাচ্ছি শুধু আমরাই নয়, আরও অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে একই জমি দেখিয়ে তিনি বায়নার টাকা নিয়েছেন। আমরা এই প্রতারক নারী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। না হলে তার দ্বারা আরও অনেক মানুষ প্রতারণার শিকার হবেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফারজানা হক চারজনের সঙ্গে বায়নার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি বায়না করেছি। এখন সবার টাকা ফিরিয়ে দেব।