স্টাফ রিপোর্টার: তিন পাশে ভারত। মাঝখানে ত্রিভুজের মতো ঢুকে গেছে বাংলাদেশের একটি চর। এই চরটির নাম মাজারদিয়াড়। বসবাস প্রায় ১২ হাজার মানুষের। সেখানে কোন হাসপাতাল নেই। আছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। সেটি খোলা হয় সপ্তাহে মাত্র দুই দিন। বাকি পাঁচদিন বন্ধই থাকে।
রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মা নদীর ওপারে পবা উপজেলার এই চর। চরের এই কমিউনিটি ক্লিনিকটি স্থাপন করা হয় ২০১৩ সালে। কিন্তু ওই চরে স্থায়ীভাবে কোন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) যেতে চান না। এখন অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন পবার হুজরিপাড়া ইউনিয়নের সিএইচসিপি সাবিনা সুলতানা। বিশাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে তিনি প্রতিদিন চরের কমিউনিটি ক্লিনিকে যান না। যেদিন যান, সেদিন ওষুধ পান চরের মানুষ। একজন পরিদর্শকের সপ্তাহে দুদিন যাবার কথা থাকলেও চরের কেউ তাকে চেনেন না।
কমিউনিটি ক্লিনিকে দুদিন জ¦র, সর্দি, কাশির মতো অসুখের ওষুধ মিললেও বেশি কিছু হলে চরের মানুষকে আসতে হয় রাজশাহী শহরে। ওই পথেই অসুস্থ অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। এখনও চরের অনেক মানুষ ভরসা রাখেন তাবিজ-কবজ আর গ্রাম্য চিকিৎসকের ওপর। চর মাজারদিয়াড় স্কুলমোড়ে ‘নুন্নাহার কমিউনিটি ক্লিনিক’। সম্প্রতি ওই চরে গেলে ক্লিনিকটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ক্লিনিকের পাশেই মাইনুল ইসলামের মিষ্টির দোকান। ক্লিনিকটি বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার লোক সপ্তাহে দুদিন আসে। কোন দিন আসবে না আসবে তার ব্যাপার।’ ক্লিনিকের পাশেই বাড়ি শাহানা বেগমের। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘চরের মানুষের লাইগা একমাত্র আল্লায় আছে। এইসব ডাক্তার-ফাক্তার তো রোজ আসে না।’
গ্রামের লোকজন জানালেন, এই শীতে পদ্মা থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাসে শিশু ও বয়স্করা ঠাণ্ডাজনিতন নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা গ্রাম্য চিকিৎসকের ওপরেই ভরসা রাখছেন। ক্লিনিক থেকে কয়েকপা এগোলেই এক বাড়িতে আছেন দুজন গর্ভবতী নারী। ১৯ বছর বয়সী আইরিন খাতুন এবার প্রথম সন্তানের মা হবেন। অনাগত সন্তানের আসার অপেক্ষায় চিন্তিত তিনি। এর চেয়েও বেশি চিন্তিত স্বাস্থ নিয়ে। আইরিনের প্রতিবেশী চাচী সুজেরা বেগম তাকে কিছু ওষুধি গাছ আর তাবিজ এনে দিলেন। আইরিন সেটা যত্নে রাখেন। আইরিন বলেন, ‘আমাদের এখানে ডাক্তার নাই। তাই চাচি তাবিজ এনে দিলো। এতে বাচ্চার সমস্যা হবে না, সবাই বলে।’
আইরিনের মতো গলায় তাবিজ নিয়ে ঘুরতে দেখা যায় আরেক গর্ভবতী নারী তসলিমা বেগমকেও। তিনিও বিশ্বাস করেন এই তাবিজ থাকলে গর্ভের সন্তানের কিছু হবে না। সমস্যা হলে অন্তত এই তাবিজ থাকলে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এ পৌঁছানো যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। চরের আরেক গর্ভবতী নারী ইতি বেগম। তাঁর বাবার বাড়ি রাজশাহী শহরের দরগাপাড়ায়। তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি বাবার বাড়ি আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ইতি বলেন, আমাদের এখানে খুব সমস্যা। বেশি সমস্যা হয় গর্ভকালীন সময়ে। আমি একবার ক্লিনিকে গিয়েছিলাম, শুধু আয়রনের ওষুধ পেয়েছি। এছাড়া কিছু পাইনি। তাই বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছি। শহরে গিয়েই ডাক্তার দেখাবো। ইতি জানান, চরের নারীদের গর্ভকালীন সময়ে ঝুঁকি বেশি। চর থেকে পারে যাওয়ার সময় বাচ্চা প্রসবের মতো ঘটনাও ঘটে। রিনা নামের এক নারী মাঝনদীতেই বাচ্চা প্রসব করেন। আবার অনেকে অসুস্থ থাকলে হাসপাতালে এ নেওয়ার সময় নদীতে মারাও যান। বছর দুয়েক আগে আগে হেলাল উদ্দিন নামের একজন ব্যক্তি ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় নৌকায় মাঝনদীতেই তিনি মারা যান।
চর মাজারদিয়াড় হরিপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড। এখানে একটি স্বাস্থ্য সহকারী এবং একটি পরিবার পরিকল্পনা সহকারীর পদও শূন্য। চরের স্কুলমোড়ে দুটি ওষুধের ফার্মেসী আছে। গ্রাম্য চিকিৎসক হাসান আলী ও ফিরোজ আলী ফার্মেসী দুটি চালান। ছোটখাট সমস্যায় চরের মানুষের চিকিৎসা তাঁরাই করেন। হাসান আলী বলেন, ‘এখানকার ক্লিনিকে তেমন চিকিৎসা হয় না। কোন দিন খোলা হবে তা কেউ জানে না। গ্রামের লোকের কিছু হলে আমার আর ফিরোজের কাছেই দেখায়। এখন শীতে রোগী বেড়েছে। বেশি অসুস্থ হলে শহরে যাচ্ছে।’
প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকটি না খোলার ব্যাপারে জানতে সেটির সিএইচসিপি সাবিনা সুলতানাকে ফোন করা হয়। মঙ্গলবার সকালে সাবিনা তখন শহরের হাইটেক পার্ক এলাকায় নৌকায় উঠছিলেন। সাবিনা বলেন, ‘গত শনিবার গিয়েছিলাম। আজ আবার যাচ্ছি। প্রতিদিন যেতে পারি না। চরে যাওয়া-আসা করতে নৌকায়-মোটরসাইকেলে চড়তে অনেক খরচ।’
তিনি বলেন, ‘চরের ক্লিনিকের স্থায়ী কোন লোক নেই। কেউ স্থায়ীভাবে যেতে চায় না। আমিও হুজরিপাড়া ইউনিয়নের দায়িত্বে আছি। রেজাউল স্যার (সাবেক উপজেলা স্থাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা) থাকার সময় আমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি সপ্তাহে দুই-তিন দিন যেতে বলেছেন। আমি সেভাবেই যাই। বাকি সময় নিজের ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করি। অফিসেরও কাজ থাকে। চরে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত কোন ভাতাও পাই না।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রাবেয়া বাসরী বলেন, ‘যতদিন চরের কারও নিয়োগ না হচ্ছে, ততদিন এ পারের লোক দিয়েই ক্লিনিকটি চালাতে হচ্ছে। সেটা এখন সপ্তাহে পাঁচদিন খোলার কথা। তিন দিন যাবেন সিএইচসিপি এবং দুই দিন একজন পরিদর্শক। তারা ঠিকমতো যাচ্ছেন কি না সেটা আমি এখনই খোঁজ নিচ্ছি।’ তিনি জানান, চরে সময় ১০ থেকে ১৫ হাজার গর্ভবতী নারী থাকেন। তাঁদের জন্য একটি ডেলিভারি সেন্টার করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য জনপ্রতিনিধিদের সাথে তিনি কথা বলছেন।