স্টাফ রিপোর্টার: টাকা ব্যাংকে রেখেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীম। রুয়েটের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক থাকাকালে তিনি এই কাণ্ড ঘটান। সম্প্রতি ইউজিসি তাঁর ব্যাপারে তদন্ত করেছে। এখন ড. আলীমই রুয়েটের উপাচার্য (ভিসি) হতে চান। তাঁর মতো আরও কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তি ভিসি হওয়ার চেষ্টায়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রুয়েটের অন্তত নয়জন অধ্যাপক রুয়েটের ভিসি হওয়ার দৌড়ে সামিল হয়েছেন। এরমধ্যে দুজন সাবেক ভিসিও আছেন। আগ্রহীদের মধ্যে একজনকে ভিসি বানাতে তিন মন্ত্রী-এমপি তাঁর নাম সুপারিশ করে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আধা সরকারি চিঠি (ডিও) দিয়েছেন। তিনজনেরই চিঠিতে একই কথা লেখা আছে। চিঠির ভাষায় একটা বাক্যেরও পরিবর্তন নেই। এই চিঠি ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৩০ জুলাই রুয়েটের সদ্য সাবেক ভিসি ড. রফিকুল ইসলাম সেখের মেয়াদ শেষ হয়। তিনি ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর মেয়াদ শেষে অ্যাপলাইড সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ অনুষদের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও ডিন ড. সাজ্জাদ হোসেনকে সাময়িকভাবে ভিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন ভিসি নিয়োগ দেবে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক ভিসি রফিকুল ইসলাম সেখও আবার ভিসি হওয়ার চেষ্টায় আছেন। তাঁর সঙ্গে ভিসি হওয়ার দৌড়ে আছেন আরেক সাবেক ভিসি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বেগ। সেখ ও বেগ রফিকুল ছাড়াও ভিসি হতে চান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
এছাড়া চেষ্টায় আছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এনএইচএম কামারুজ্জামান সরকার, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বিভাগের ড. ফারুক হোসেন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফী, কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ড. নজরুল ইসলাম মণ্ডল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীম এবং রুয়েটের সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. মোশাররফ হোসেন।
এদের মধ্যে ড. নীরেন্দ্রনাথ মুস্তফীর জন্য শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে ডিও দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এবং নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার। তিনজনের চিঠির ভাষা একই। একটা বাক্যেও অমিল নেই। গত ২৬ জুলাই তাঁরা এই চিঠিতে সই করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের ধরে এমন ডিও লেটার নেওয়ায় ড. নীরেন্দ্রনাথের ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে রাজশাহীতে। বিষয়টি নিয়ে ড. নীরেন্দ্রনাথকে ফোন করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
সদ্য সাবেক ভিসি ড. রফিকুল ইসলাম সেখকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ভিসি থাকাকালে তিনি অনিয়ম করে আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। মেয়াদের শেষ সময়ে ইউজিসি এ অভিযোগও তদন্ত করেছে। অথচ তিনিও আবার ভিসি হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে ড. রফিকুল ইসলাম সেখ বলেন, ‘সরকার যদি চায় তাহলে আবার ভিসি হতে রাজি আছি।’ তাঁকে নিয়ে থাকা বিতর্ক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্য কারও চাকরি হলে কোনো দোষ নেই। শুধু আমাদের আত্মীয়-স্বজনের হলেই দোষ। তারাও তো নিজ যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী চাকরি পেতে পারে।’
আরেক সাবেক ভিসি রফিকুল ইসলাম বেগও তাঁর আমলে অনিয়ম-দুর্নীতি ও আত্মীয়করণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। ভিসি হওয়ার দৌড়ে অংশ নেওয়া আরেক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীম রুয়েটের গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক বিভাগ চালু করার প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকার প্রকল্পের মধ্যে ৭ কোটি ১৪ লাখই তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি ইউজিসি এ অভিযোগ তদন্ত করে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছে। তাও ভিসি হওয়ার চেষ্টার বিষয়ে কথা বলতে ড. আলীমের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
ড. নজরুল ইসলাম মণ্ডল ভিসি হওয়ার জন্য ব্যাপক তদবির চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনি রুয়েট থেকে গবেষণার জন্য ছুটি নিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইসি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। নিয়মবহির্ভুতভাবে সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলর সভায় তাঁর ছুটির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে ছুটিকে লিয়েন হিসেবে বিবেচনা করার মত দিয়েছে। তবে ড. নজরুল সেটিকে গবেষণা ছুটি হিসেবে অনুমোদনের জন্য বর্তমান প্রশাসনকে চাপ দিচ্ছেন। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে তিনি নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। তাঁকেও ফোন করা হলে তিনি কোন বিষয়েই কথা বলতে চাননি।
বিতর্কিতদের ভিসি নিয়োগ দিলে সরকারের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন হবে তেমনি শিক্ষার মান ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন সুশাসন বিশ্লেষকেরা। একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশের মাধ্যমে ভিসির নিয়োগ হলে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের চাটুকারিতাতেই ব্যস্ত থাকবেন বলেও মনে করেন তাঁরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে। সেটি অনুসরণ করা উচিত। আর তা না হলে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে তাদের নিয়োগ যেন কোনভাবেই না হয়। সেটি হলে রাষ্ট্রের, জনগণের ও শিক্ষার ক্ষতি হয়। সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে ভিসি নিয়োগ দিলে ব্যাপারটি আরও খারাপ হবে। ওই ভিসি সেই রাজনৈতিক নেতার কথার বাইরে চলতে পারবেন না।