সচেতনতা বাড়লে নরিাপদ হবে সড়ক

তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক কষ্টে মুষড়ে পড়েছেন আহসান হাবিব। হাসপাতালের কক্ষটিতে আছেন দেড় মাস হলো। সড়ক দুর্ঘটনায় থেতলে যাওয়া দুটো পায়ের একটি কোনোমতে রক্ষা পেয়েছে, আরেকটি অপারেশন করে বাদ দেয়ার বিকল্প ছিলনা। কয়েকদিন হলো শরীরের নিচের অংশের অনুভূতি ফিরে এসেছে, বোঝাই যাচ্ছে ওখানকার স্নায়ুগুলো পুনরায় কাজ করা শুরু করেছে। তবে শরীরটা এখনো অনেক দুর্বল। দুর্ঘটনার আগে জনাব হাবিব প্রতিদিন খুলনার বাসা থেকে সকাল নয়টায় ডুমুরিয়ায় যেতেন, আর ফিরতেন সন্ধ্যা ছয়টায়। একটি সরকারি ব্যাংকের ডুমুরিয়া উপজেলার শাখা ব্যবস্থাপক তিনি। স্ত্রী চাকরি করেন খুলনা শহরে আর ছেলে-মেয়েদুটোও পড়ছে নগরীর নামকরা স্কুলে। তাই কষ্ট হলেও খুলনা থেকেই প্রতিদিন অফিস করতেন তিনি। দুর্ঘটনার দিন সকালে সিএনজি অটোরিক্সায় ডুমুরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রী হয়েছিলেন তিনি-সহ আরো চারজন। এ রাস্তাটিতে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের সংখ্যা বেশি। এমনই এক বাঁকে উচ্চগতির একটি মালবোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপা দেয় অটোরিক্সাটিকে। চালক ও তার পাশে বসা যাত্রীটি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। হাবিবসহ পেছনের সিটে বসা তিনজন মারাত্মকভাবে আহত হন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য তাকে পাঠানো হয় রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান নিটোরে। কেবল হাবিব নন, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার অনেকেরই নিয়মিত জীবনের ছন্দপতন এভাবেই শুরু হয়।
বাংলাদেশের সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বছরে প্রায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোনায়েম হোসেন বলেন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশনের (নিটোর) ইমার্জেন্সিতে প্রতিদিন ৩০০ রোগী আসে, যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। বর্তমান বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে সড়ক দূর্ঘটনা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নিরাপদ সড়ক এখন সময়ের দাবি,সারা বিশ্বের মানুষের দাবি। যদিও দুর্ঘটনা কারোর কাম্য নয়, তা সত্ত্বেও সড়ক সবসময় নিরাপদ হয়না। প্রতিনিয়ত সেখানে বেড়ে চলছে মৃত্যুর প্রহসন। দুর্ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ।
পত্রিকায় পাতায় কিংবা টেলিভিশনে সড়ক দুর্ঘটনায় খবর দেখে আমরা হতাশ হই। রাস্তা পার হতে গিয়ে বাস কিংবা ট্রাকের চাপায় নিহত, বাসে বাসে সংঘর্ষ, বেপরোয়া গতির যানের আঘাতে পাশে থাকা মটর সাইকেলের চালক কিংবা মাইক্রোবাসের ভিতরে থাকা মানুষগুলো হয় গুরুতর আহত, নয় নিহত। এটা যেন নিত্যকার খবর। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক নিয়ম না মানা, পথচারীর ট্রাফিক আইন না জানা ইত্যাদি। এছাড়াও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার অভাবও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে সবসময়ই বিবেচিত হয়। সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বেশি শিকার হয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বৃদ্ধ, শিশু ও কর্মজীবী মানুষ। এর ফলে হারিয়ে যাচ্ছে কারো মা-বাবা, কারো সন্তান কিংবা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে একেকটি পরিবার। এর পরও আমাদের অনেকেরই ট্রাফিক আইন ও রাস্তা পারাপারের নিয়মনীতি অজানা। জনমনে সচেতনতা, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমেই এই দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।
২০১৮ সালে সড়ক আইন সংশোধনের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল সড়কে চলাচল জনসাধারণের জন্য আরও নিরাপদ হবে কিন্তু এখন তার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে সড়ক দুর্ঘটনা, ঝরে পড়ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। অনেকেই আবার বেঁচে ফিরছে আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে, কষ্টে ভুগতে হচ্ছে সারাজীবন। তাইতো বলা হয় ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। প্রথমত, নিরাপদ সড়কের সুব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় বাঁক কমাতে হবে, কারণ অধিকাংশ দুর্ঘটনা রাস্তার বাঁকে ঘটে থাকে। রাস্তার প্রতিটি মোড়ে বড়ো আকারের উত্তল দর্পণ স্থাপন করতে হবে, যাতে চালকরা মোড়ের বিপরীত পাশের গাড়িগুলো আগে থেকেই দেখতে পারেন এবং সতর্ক হতে পারেন। নিয়মিত যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করতে হবে। লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজন মতো ওভার ব্রিজ নির্মাণ, যানবাহন চালানোর সময় ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা, ওভার টেকিংয়ের ব্যাপারে চালকদের সতর্ক হওয়া, লাইসেন্সবিহীন যান রাস্তা থেকে অপসারণ ও জনসাধারণকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমতে পারে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগে সচেষ্ট হতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি জীবনের মূল্য অপরিসীম, তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে জীবনরক্ষা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিশ্বে সড়কপথে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। দেশে সড়কপথে চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি ঘটে ২৮৭ জনের। এদিক থেকে বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে কেবল জিম্বাবুয়ে। দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২১৭ জনের। এর বাইরে আর কোনো দেশে বাস সম্পৃক্ত দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানির নজির নেই। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোড সেফটি সংক্রান্ত সাম্প্র্রতিক সময়ের প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় চলাচলরত প্রতি ১০ হাজার বাসের বিপরীতে বাস দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে যথাক্রমে ৮৭ ও ৮ জনের।বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে বাসের দায় ২৬ শতাংশ হলেও বিশ্বের অন্য কোনো দেশে তা ১৫ শতাংশের বেশি নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০১৮ প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী বাস দুর্ঘটনাপ্রবণ অন্য দেশগুলোর মধ্যে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ায় এ হার ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া ঘানায় ১৩ শতাংশ, কাতারে ১২, বারবাডোজে ১১, মালিতে ১০, আইভরি কোস্টে ৮ ও কিউবায় ৭ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ হার কমবেশি ১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বাস দুর্ঘটনা কীভাবে কমানো যায় এ নিয়েও ভাবনা জরুরি।
দেশে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের বিপরীতে কত যানবাহন চলতে পারে এ ধরনের কোনো হিসাব ছাড়াই যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন রাস্তায় নামছে পাঁচ শতাধিক নতুন যানবাহন। নিবন্ধিত ৫৪ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৭০ শতাংশই হলো মোটরসাইকেল। প্রায় ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে এই যানে। বিপজ্জনক এই যানে একটি দেশের মূল জনশক্তি হিসেবে বিবেচিত তরুণদের মৃত্যু আশঙ্কাজনক বাড়ছে, যা সত্যিই বড়ো রকমের উদ্বেগের কারণ। তাই এই মৃত্যুযান নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।
সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পরিকল্পিত নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান সড়কগুলো সংস্কার ও নতুন সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনার সময় দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয় মাথায় রাখতে হবে। পরিকল্পনার মাধ্যমে সড়ক টেকসই ও নিরাপদ করতে প্রকৌশলীদের ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু, কীভাবে সড়ক নিরাপদ হবে, সড়কের সঙ্গে শহর ও গ্রামের সমন্বয়, কোথায় কোন ধরনের সড়ক প্রয়োজন, সড়কের কোথায় মানুষের পারাপারের সুযোগ থাকবে, কোথায় যানবাহনের গতি কত থাকবে ও কোথায় গতিরোধক হবে, কোথায় মিশ্র যান চলবে, কোন সড়কে অযান্ত্রিক যান চলবে কোন সড়কে চলবে না-এসব ক্ষেত্রে স্থাপত্যবিদ্যা এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনার সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি, সড়ক নির্মাণ ও যাতায়াত পরিকল্পনায় সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজকরা একাডেমিক প্রতিষ্ঠান যেমন- বুয়েটের একসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর মতো সামাজিক সংগঠনসমূহের যুক্ত থাকা প্রয়োজন।
বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা একটি আতঙ্কের নাম। এর ভয়াবহতা থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে সরকারসহ সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। ট্রাফিক আইন আধুনিকীকরণ ও কঠোরভাবে কার্যকর করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে আকর্ষণীয়ভাবে ট্রাফিক সপ্তাহ উদযাপন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনাসভা ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শণ করা যেতে পারে। সরকারি-বেসকারি ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়কগুলো যেমন নিরাপদ হবে, তেমনি নিরাপদ হবে মানুষের জীবন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুনঃ   সবার উপরে মানুষ সত্য : নাসরীন মুস্তাফা

লেখক: ম. জাভেদ ইকবাল
সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা।
পিআইডি ফিচার