প্রচার বিভাগকে সরকারের চোখ, কান ও মুখপাত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে প্রচার বিভাগ যদি সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে সেই প্রচার বিভাগ কখনোই সরকারের প্রকৃত চোখ, কান ও মুখপাত্র হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের প্রচার বিভাগ অর্থাৎ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের ক্ষেত্রেও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সত্যিকার অর্থে সরকারের চোখ, কান ও মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছে।
আমরা সকলেই জানি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল হলো এই অন্তর্বর্তী সরকার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ এবং আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রচার করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর-সংস্থাসমূহ আন্দোলনের সামগ্রিক তথ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ জনস্মৃতিতে জীবন্ত করে রাখতে তথ্য অধিদফতর (পিআইডি) বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের নির্বাচিত স্থিরচিত্র নিয়ে পিআইডি ইতোমধ্যে ‘রক্তস্নাত জুলাই বিপ্লব’ শিরোনামে ফটো অ্যালবাম প্রকাশ করেছে। এই অ্যালবামে গত ৫ই জুন থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন ঘটনার স্থিরচিত্র স্থান পেয়েছে। এছাড়া পিআইডি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ‘রক্তস্নাত জুলাই বিপ্লব’ শিরোনামে ১০ খণ্ডের সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে প্রথম দুই খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ৮ খণ্ডের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর পাশাপাশি পিআইডি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ ও প্রতিবেদনের ভিডিও সংকলন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভিডিও সংগ্রহের কাজও চলমান। ইতোমধ্যে তথ্য অধিদফতর এক হাজারের অধিক ভিডিও সংগ্রহ করেছে। এছাড়া তথ্য অধিদফতর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের ওপর ৬৬টি তথ্যবিবরণী ও ১১৪টি স্থিরচিত্র রিলিজ করেছে, যা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। এর পাশাপাশি পিআইডির উদ্যোগে রাষ্ট্র সংস্কার, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও বৈষম্য নিরসনসহ সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়সমূহের ওপর ১৩টি ফিচার ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ১৪টি প্রামাণ্যচিত্র, ৬টি ডকুড্রামা ও ১২টি টিভি ফিলার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ওপর অঙ্কিত গ্রাফিতি-বিষয়ক সচিত্র অ্যালবামের প্রথম খণ্ডের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন মুদ্রণের কাজ চলমান। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজও শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ওপর প্রামাণ্য গন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ এবং আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের জীবনের গল্প নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বর্তমান বিটিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, ‘ফ্যাসিবাদের দিনলিপি’, ‘আগামীর বাংলাদেশ’, ‘নিপীড়নের গল্প’, ‘এই ত্যাগ রবে অম্লান’ প্রভৃতি। এসব অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশন জনস্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিটিভির অনুষ্ঠান ও সংবাদের মানেও এসেছে গণগত পরিবর্তন। এখন বিটিভিতে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করা হয়। সরকারের সমালোচনাকারীদেরও বিটিভিতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। যা ইতঃপূর্বে কখনোই হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ও আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণ বিষয়ে বাংলাদেশ বেতারও বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিত বিষয়ে বেতারে নিয়মিত কথিকা, আলোচনা, আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার এবং ফোন-ইন অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ বেতার রাষ্ট্র সংস্কার, তারুণ্যের শক্তি ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণ বিষয়ে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, আলোচনা, উদ্দীপনামূলক গান ও নাটিকা প্রচার করছে।
মাঠ পর্যায়ে সরকারের একমাত্র প্রচার প্রতিষ্ঠান হলো জেলা তথ্য অফিস। বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের অধীন ৬৪টি জেলা তথ্য অফিস এবং পার্বত্য অঞ্চলে ৪টি তথ্য অফিস প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, উঠান বৈঠক, নারী সমাবেশ, আলোচনা সভাসহ ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রচার কার্যক্রমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা এবং আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের জীবনের গল্প তুলে ধরা হচ্ছে। এছাড়া আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারুণ্যের ভাবনাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে জেলা তথ্য অফিসসমূহ কিশোর-কিশোরীদের অংশগ্রহণে ‘আমার কিছু বলার আছে’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা আয়োজন করছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অডিও-ভিজ্যুয়াল দলিল স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। ‘দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর অডিও-ভিজ্যুয়াল দলিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ’-শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের ভিডিও সংগ্রহের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু করেছে। আন্দোলনের ভিডিওসমূহ সংগ্রহ শেষে তা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দপ্তর-সংস্থাও কাজ করছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অনেক ঘটনা এখনো আমাদের অজানা। এসব অজানা ঘটনা জাতির সামনে উপস্থাপন করা গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যাঁরা শহিদ ও আহত হয়েছেন, তাঁরা আমাদের জাতীয় বীর। জাতি তাঁদের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হলে আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহের তথ্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। এই আন্দোলনের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রচারে সরকারের বহুমুখী উদ্যোগ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
#
লেখক : মো. মামুন অর রশিদ,জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
পিআইডি ফিচার