মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২৯৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে। জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন নারী। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে । ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, এদের মধ্যে পাঁচ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী, ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী ও নারীও রয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যার দুইটি ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে। দেশের গণমাধ্যমে এ সংবাদটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ঘটেছে, যা জাতীয় জীবনে অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্রুপের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনে কোন না কোন সময় শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমএসএফ এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে এক হাজার ১৫১ জন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮১ জন নারী ও ৩৩১ জন শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে সাত জনকে, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৮ জন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৩৮ জন। দেশে প্রতিদিন ১৩ জনের বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। নানা অজুহাতে শিশু ও নারী ধর্ষণ, নারীকে হেনস্তা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র দেশে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং তাদের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি গ্রেফতার করতেও পুলিশ অনেক সময় অনীহা প্রকাশ করে। গ্রেফতার হলেও ভুক্তভোগীর পরিবারকে নানা রকম হুমকি-ধামকি দিয়ে থাকে, জামিনে বেরিয়ে এসে আরও বেশি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এতে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতাসহ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে । ভুক্তভোগী নারী ও শিশুরা সমাজে গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। কেউ আবার আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। দ্রুত বিচার করে ধর্ষককে জনসম্মুখে শাস্তি দেওয়া গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০( ২০০০ সনের ৮ নং আইন ) এ ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন,তাহা হলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। এধারার ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বছরের অধিক বয়েসের কোন নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি নিয়ে বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন কাজে লিপ্ত হয়,তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য করা হবে। যদি কোন ব্যক্তির ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী অন্য কাজের জন্য ধর্ষণের শিকার নারীর মৃত্যু হয় তাহলে ঐ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হয়,তাহলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন,তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোন নারী ধর্ষণের শিকার হন,তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে ,সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধি ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা এবং ৩৭৬ ধারাতে ধর্ষণের শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দণ্ডবিধির আওতায় ধর্ষণের মামলা করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আত্ততায় অনেক সময় মামলা করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ধর্ষণ মামলা করাকে আইনের ভাষায় ‘ডকট্রিন অব ইমপ্লাইড রিপিল’ বলে।নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে ধর্ষণের মামলা করার কারণ হল এই আইন স্পেশাল আইন।আর স্পেশাল আইনের আত্ততায় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।ধর্ষণের মামলা আমলে (কগনিজেন্স) নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। দণ্ডবিধির অধীনে যদি ধর্ষণের মামলা করা হয় তাহলে মামলা আমলে (কগনিজেন্স) নিবে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে কোনো ধর্ষণের মামলা হলে সেই মামলা আমলে নিবেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। কোন ম্যাজিস্ট্রেটের এই আইনের অধীনে মামলা আমলে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে মামলাটি আসলে তিনি মামলাটি রেডি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দিবেন। তারপর ট্রাইব্যুনাল মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার সম্পন্ন করবে।
বাংলাদেশে পুরুষেরা ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যায়। ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা কম। কারণ বিদ্যমান সংশ্লিষ্ট আইনে কোনো পুরুষ যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার জন্য আইনে প্রতিকার পাওয়ার কোনো বিধান নেই। বিচার চাইতে হয় ভিন্ন আইনে।তবে আশার কথা হলো বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী ১১১ জন ছেলে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে কেবল ৫৫টি। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২২৬ জন ছেলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে ১৪৬টি। আর ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল এই পাঁচ বছরে ২৪ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। এসময়ে মামলা হয়েছে ১৪টি।
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার যৌন নিপীড়নকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে যৌন নিপীড়নকে মোকাবিলায় হটলাইনও চালু করেছে। নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তর হটলাইন সেবা চালু করেছে। হটলাইন নম্বরগুলো হলো: ০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২ ও ০১৩২০০০২২২২। রাস্তা-ঘাটে যেকোনো ঘটনা ঘটলে হটলাইনে ২৪ ঘণ্টা টাইম থাকবে অভিযোগ দেওয়ার জন্য। এটা তদারকি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ডেডিকেটেড সেলও থাকবে। এছাড়াও সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের আইনি সেবা ও সুরক্ষা দিতে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজ আগের মতোই চালু আছে। এছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেও অভিযোগ জানানো যাবে। আশা করা হচ্ছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ এবং সমাজের সকল স্তরের সচেতন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে যৌন নিপীড়নকে অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ইমদাদ ইসলাম