বায়ুদূষণ থেকে কি মুক্তি নেই?

প্রিয়, আমি কিছু কথা বলতে চাই। সামান্য সময় হবে তোমার? এই যে তুমি খক্ খক্ করে কাশছ, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তোমার, তোমার পোশাক ও চুলে জড়িয়ে যাচ্ছে ধুলা, এসব কিছু নিয়ে তুমি ভালো নেই। তুমি ভালো না থাকলে আমারও তো ভালো থাকা হয় না। সেজন্যই তোমার সাথে কথা বলা দরকার। আমাকে বাঁচানোর জন্য এবং তোমাকে ও তোমাদেরকে বাঁচানোর জন্য কথা না বলে পারছি না।
প্রিয়, আমি কে জানতে চাইছ তো? আমি তোমার দেশ, খুব ভালোবেসে তুমি আমার নাম দিয়েছ ‘বাংলাদেশ’। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাও না বলে সকল দেশের সেরা দেশের স্থানে আমাকে স্থান দিয়েছ তো তুমিই। অথচ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’ পড়ে দেখ, তোমার সেই সেরা দেশটি ২০২৪ সালে বায়ুদূষণে দেশ হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে, তোমার দেশের রাজধানী হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নগরী বলে খ্যাত ঢাকা শহর হিসেবে আছে তৃতীয় অবস্থানে। এর আগের বছর বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণের দেশ হিসেবে পত্রিকার পাতায় খবর পড়েছ। ঢাকা ছিল শহর হিসেবে দ্বিতীয়, সে খবরও পড়েছ।
তুমি হয়তো জান, বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপের আন্তর্জাতিক একটি পদ্ধতি রয়েছে। সাধারণত এই দূষণের পরিমাণ পিএম ২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার) বা ক্ষুদ্রতম কণার ঘনত্বের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। এই ক্ষুদ্রতম কণা মানুষের শ্বাসতন্ত্রের জন্য খুব ক্ষতিকর বলেই এর ঘনত্ব পরিমাপ করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডবিউএইচও’র মানদণ্ড অনুযায়ী, পিএম ২.৫-এর গড় বার্ষিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশর প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার অর্থাৎ পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০২৩ সালে ছিল ৭৯.৯ মাইক্রোগ্রাম। ডবিউএইচও’র মানদণ্ডের চেয়ে দূষণের পরিমাণ অন্তত ১৫ গুণ বেশি, এই তথ্য জেনে আমি ভয় পেয়েছি। তুমিও কী স্বস্তি পাচ্ছ?
মূলত রাজধানী শহর ঢাকা ও তোমাদের গড়ে তোলা বড়ো বড়ো শহরগুলোর দূষণের মাত্রা বেশি হওয়ায় তোমার দেশ দূষিত হয়ে পড়েছে, এ কথা বিজ্ঞজনরা বলছেন। তবুও সারা দেশের মানুষ ভিড় করছে ঢাকাসহ বড়ো বড়ো শহরেই। তোমাদের জীবিকার প্রয়োজনে তোমরা শহরে আসছ, একইভাবে গ্রামকেও দূষিত করছ। তোমাদের যানবাহন দরকার। যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অল্প জমিতে অনেক অনেক মানুষের বসবাস ও কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়, তখন সৃষ্টি হয় ধুলাবালির যা বায়ুতে দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের জন্য নগরায়ণের ফলে ভারি শিল্প, যেমন টেক্সটাইল, চিনি কল ইত্যাদি কারখানা থেকে সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং এরকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বর্জ্য হিসেবে নির্গত হচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণ করছে। অধিক ফসলের আশায় ফসলের জমিতে ফসলের অবশিষ্টাংশ আগুনে পোড়ানোর মতো পরিবেশের ক্ষতিকর কৃষি-কৌশল প্রয়োগ করতে হয় তোমাদের। কাঠ, বর্জ্য পদার্থের মতো অপরিশোধিত জ্বালানি ব্যবহার করো তোমরা, যা ক্ষতিকর গ্যাসের সৃষ্টি করে। আমি কখনোই কিছু বলিনি। তোমাদের ভালো থাকা আমার ভালো থাকা বলে ভেবেছি। মেনে নিয়েছি, প্রিয়, মেনে নিয়েছি তোমাদের সব কাজ। দিনকে দিন শ্বাসকষ্ট, হৃদ্‌রোগ, যক্ষ্মা, ক্যান্সার ও নানা রকমের শারীরিক সমস্যায় তোমরা কষ্ট পাচ্ছ, তোমাদের শিশু আর বয়স্করা আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছে দেখেও কিছু বলতে পারিনি। কেননা, তোমরা মানুষরা নানা উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করো, অনেক সময় সফল হও বলে ভেবেছি বায়ুদূষণের সমসাধানও তোমরা করে ফেলবে। কিন্তু প্রিয়, খুব বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না তোমার? বায়ুদূষণের ফলে প্রাণী ও গাছপালার উপর নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আর এরা নিজে থেকে সমস্যা সমাধান করতে পারে না, সেটা তুমিও জান। প্রিয়, তুমি কি ভেবে দেখেছ দূষিত বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ, যেমন পিএম ২.৫, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং অজৈব পদার্থসমূহ তোমাদের উপর নির্ভরশীল প্রাণী ও গাছপালার উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে? পাখি এবং গবাদি পশুরা আগের চেয়ে অনেক বেশি শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে। প্রাণীদের হৃদ্‌যন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমছে, ওদের প্রজনন ক্ষমতার উপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। প্রাণীদের আক্রমণাত্মক আচরণ বেড়ে যাওয়ার পেছনেও যে বায়ুদূষণ দায়ী!
প্রাণীদের নিয়ে খুব একটা ভাবতে না চাইলেও গাছপালা নিয়ে যে ভাবতেই হবে তোমাকে। গাছ তোমাকে অক্সিজেন দেয়, যা তোমার বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বায়ুদূষণের ফলে গাছের পাতায় জমে থাকা দূষিত কণাগুলো গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। ফলে বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ কম করে গাছ। অক্সিজেনও কম উৎপাদন করে। বাতাসে অক্সিজেন কমতে কমতে যদি নাই হয়ে যায়, তুমি কীভাবে শ্বাস নেবে প্রিয়? দূষিত বায়ু গাছের বৃদ্ধি এবং ফলন কমিয়ে দিচ্ছে। তুমি ভবিষ্যতে খেতে পারবে তো প্রিয়?
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, বায়ুদূষণ থেকে তোমার দেশের মুক্তি কীভাবে ঘটবে, এ নিয়ে ভাবতেই হবে তোমাকে। আমি প্রায়ই শুনি, বাংলাদেশকে নাকি সুইজারল্যান্ড বানাতে চেষ্টা করছ তোমরা। তাহলে সুইজারল্যান্ডের মতো বিশ্বের অনেক দেশ বায়ুদূষণের পরিমাণ কম রাখতে পেরেছে, তুমি এবং তোমরা কেনো পারছ না? ঐসব দেশের মতো উন্নত পরিবেশগত নীতি, কঠোর আইন, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে তুমি এবং তোমরাও তো পার বায়ুদূষণ রোধ করতে। কাজ না করে বেশি বেশি কথা বললে কিন্তু কাজ হবে না। কাজ করতে গিয়ে দুর্নীতি করলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। এরকম অনেক লজ্জাজনক উদাহরণ তোমরা তৈরি করেছ। প্রিয়, আর সময় নেই বুঝতে হবে তোমাকে। বছরের পর বছর উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের মাঝে বাস করলে কিছু করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, বুঝতে হবে তোমাকেই। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘মাত্র ছয় মাসে বায়ুমানের অনেক উন্নতি হবে, তা আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি, যাতে এমন আশা করতে পারি যে আগামী শুকনা মৌসুমে ঢাকা এবং দেশের অন্যত্র বায়ুমানের উন্নতি হবে।’
পলিথিন নিষিদ্ধ করা, মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ কমানো নিয়ে সরকারের চেষ্টা থাকলেও তুমি এখনো পলিথিনের মায়া কাটাতে পারোনি, দেখছি তো! কাপড় আর পাটের ব্যাগের মতো বারবার ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ ব্যবহারকে তুমি গুরুত্বের সাথে নিচ্ছ না। উপদেষ্টা বলেছেন, ধুলাদূষণ কমানোর জন্য ঢাকার রাস্তার পাশের খোলা স্থান ঘাস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হবে। ঢাকাসহ সব বড়ো শহর, দেশের সব রাস্তার পাশেই ঘাস এবং নানা রকমের গাছ লাগালে পরিবেশের উন্নতির জন্য ভালো কিছু করা হবে। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ইটভাটা সারা দেশে সাড়ে ছয় হাজার, উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে হিসাবটা জানলাম। মাত্র ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন নজরদারির জন্য, যা কতটা অপ্রতুল তা না বললেও চলে। রাস্তাঘাটে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনগুলো রিসাইকেল বা প্রতিস্থাপন করা, পরীক্ষার মাধ্যমে জিরা টলারেন্স দেখিয়ে দূষিত গ্যাস নির্গমনকারী যানবাহনের লাইসেন্স বাতিল করা, গণপরিবহণ সিস্টেমের উন্নয়ন এবং ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। নির্মাণ কাজের সময় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও আইনের কঠোর প্রয়োগ দেখতে চাই। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো, যেমন সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রচলন বাড়াতেই হবে। কৃষকদের কৃষির অবশিষ্টাংশ না পুড়িয়ে জৈব সার বানিয়ে পুনরায় ব্যবহার ও কৃষিতে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সচেতন করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে এসব নিয়ে লিখতে হবে, যাতে দেশের আগামী প্রজন্ম বায়ুদূষণ ঠেকানোর সৈনিক হিসেবে বড়ো হয়ে উঠতে পারে।
মানলাম, এর অনেককিছুই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের ব্যাপার। মানুষকে সচেতন করতে এবং নিজে সচেতন হয়ে বায়ুদূষণ ঠেকাতে তোমার কি কিছু করার নেই? তুমিও তো পার তোমার চারপাশে যতটুকু খালি জায়গা আছে, সেখানে গাছ লাগাতে। ঘরের ভেতরটা ঠান্ডা রাখে, বায়ুদূষণ কমায় এমন গাছ দিয়ে তোমার নিজের পরিবেশটা উন্নত করার চেষ্টা তুমি কী করেছ? তোমার প্রিয় দেশের বুকে সবুজ অঞ্চল বাড়িয়ে তুলতে তোমার দু’হাত বাড়িয়ে দাও প্রিয়। তোমার দেখাদেখি এক এক করে আরও অনেক অনেক হাত বাড়ানোর দৃশ্য দেখব, এই স্বপ্ন দেখতে আমি যে খুব ভালোবাসি।
#
লেখক: নাসরীন মুস্তাফা

আরও পড়ুনঃ   সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ হয় না, হবেও না....

কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার
পিআইডি ফিচার