গুজব প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও গণমাধ্যম সাক্ষরতা

কান চিল নিয়ে গেছে। কানের অবস্থান না দেখেই চিলের পিছনে ছোটা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সত্যতা যাচাই না করে কোনো ঘটনা বিশ্বাস করা মানুষের সহজাত প্রবণতা। এই প্রবণতা থেকে গুজবের সঙ্গে মানুষের সখ্য গড়ে ওঠে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের যেমন অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি গুজবের পরিমাণও বেড়েছে। গুজব এক ধরনের তথ্যসন্ত্রাস। গুজব প্রাচীন ও আধুনিক উভয় মানব ইতিহাসের একটি অংশ। গুজব প্রতিরোধ করা বর্তমান সময়ের বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনসচেতনতা ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার কোনো বিকল্প নেই।

সত্য নয়; তবে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করা ভুল কিংবা অসংগত তথ্যকে গুজব হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অনেকের মতে, গুজব হচ্ছে প্রচারণার একটি উপসেট। গুজব প্রচার করা এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গুজব ছড়ানোর ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। চিত্রকর্ম, কার্টুন, পোস্টার, পুস্তিকা, অডিয়ো, ভিডিয়ো, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সাইবার জগতে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ছবিতে ভিন্ন স্থান ও সময়যু্ক্ত করে ছবির প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের মাধ্যমে গুজব সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মিথ্যা ও অসংগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চটকদার ভিডিয়ো তৈরি করে অনেকে গুজব ছড়াচ্ছেন। এ ছাড়া পুরোনো ভিডিয়োকে বর্তমান সময়ের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করেও ভুয়া ভিডিয়ো তৈরি করে গুজব ছড়ানো হয়। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার জন্যও মিথ্যা তথ্যনির্ভর কন্টেন্ট তৈরি করে তা সাইবার জগতে ছড়িয়ে দেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-এর পদত্যাগের বিষয়ে গুজব ছড়ানো হয়। বিভিন্ন সুপরিচিত গণমাধ্যমের আদলে ফটোকার্ড তৈরি করে প্রচার করা হয়— ‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন’। অনেকেই আবার এ ধরনের ফটোকার্ড ফেসবুকে শেয়ারও করেছেন। সদ্য সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের পদত্যাগ নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছিল। গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়— ‘পদত্যাগ করেছেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম’। অনেকে পদত্যাগের ফটোকার্ড শেয়ার করেছেন, যেখানে লেখা ছিল ‘পতাকাবাহী গাড়ি নিয়ে যমুনায় ঢুকে পতাকা ছাড়া গাড়িতে বের হলেন নাহিদ’। প্রকৃত ঘটনা হলো, সেইদিন অর্থাৎ ২৩শে ফেব্রুয়ারি তিনি পদত্যাগ করেননি। তিনি ২৫শে ফেব্রুয়ারি উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং নিজেই তা গণমাধ্যমকে জানান। সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ দেওয়া নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়— ‘অন্তর্বর্তী সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ দিচ্ছে’। বাস্তবতা হলো সরকার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এভাবে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে একটি চক্র দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।

গুজব শনাক্তকরণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। গুজব শনাক্তকরণের প্রথম ধাপ হলো তথ্যের চরিত্র-নির্ধারণ। কোনো তথ্য যখন কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে উঠবে, তখন ওই তথ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে তথ্যের উদ্দেশ্য তথা চরিত্র-নির্ধারণ করতে হবে। এরপর তথ্যের উৎস চিহ্নিত করতে হবে। অর্থাৎ, কে তথ্য তৈরি করে প্রচার করছে, কার কাছ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসলো, তা যাচাই করে দেখতে হবে। তথ্যের উৎস কখনো কখনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান হতে পারে, আবার কখনো ব্যক্তিও হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত কোনো তথ্য যদি গুজব হিসাবে বিবেচিত হয়, তাহলে প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে হবে। তিনভাবে গুজবের প্রতিকার হতে পারে— আইনগত প্রতিকার, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং ফ্যাক্ট চেকিং ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ।

আরও পড়ুনঃ   বিলুপ্ত হওয়া বিষধর রাসেল ভাইপার ফিরে এসেছে ভংঙ্কররুপে!

গুজব ও অপপ্রচারের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে বিভ্রান্ত করা। মানুষ যাতে গুজবে কান না দেন, সেজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। গুজব প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’। একটি গল্পের মাধ্যমে ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। একদিন একজন লোক বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের কাছে এসে বললেন, ‘সক্রেটিস, তুমি কি জানো এইমাত্র আমি তোমার বন্ধুর ব্যাপারে কী শুনে এলাম? সক্রেটিস বললেন, ‘আমার বন্ধুকে নিয়ে ঘটনাটি শোনার আগে আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করব। প্রথম প্রশ্নটি সত্য-মিথ্যা নিয়ে। তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ, তা কি নির্ভেজাল সত্য? লোকটি উত্তর দিল, না; আমি জানি না, এটা সত্য কি না। আসলে আমি একজনের কাছে শুনেছি।’ সক্রেটিসের দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি আমার বন্ধু সম্পর্কে ভালো কিছু বলবে?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘না’। তৃতীয় প্রশ্ন, তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ, তা কি আমার জন্য উপকারী? লোকটি উত্তর দিল, ‘না’। এরপর সক্রেটিস বললেন, ‘তুমি আমাকে যা বলতে চাও, তা সত্যও নয়, ভালো কিছুও নয় এবং আমার জন্য উপকারীও নয়, তবে আমাকে বলে কী লাভ!’

উল্লিখিত ঘটনাটি থেকে এটি পরিষ্কার যে, কোনো একটি তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে তা প্রচার করা ঠিক নয় এবং এ রকম প্রচারণায় কান দেওয়াও উচিত নয়। কোনো একটি বিষয় বা তথ্যকে বিশ্বাস করার আগে আমরা তা সক্রেটিসের দর্শনভিত্তিক ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’ করে নিতে পারি।

গণমাধ্যম সাক্ষরতাকে গুজব প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যে দক্ষতা বা ক্ষমতা একজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণ, সমালোচনা এবং মূল্যায়ন করতে সহায়তা করে, তাই গণমাধ্যম সাক্ষরতা। এটি কেবল সংবাদপত্র, রেডিয়ো বা টেলিভিশনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করছে। এই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হলে জনগণকে গণমাধ্যম সাক্ষর করতে হবে। জনগণ গণমাধ্যম সাক্ষরতা অর্জন করলে তাঁরা নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য শনাক্ত করতে পারবে। বিষয়টি বিবেচনা করে অনেক দেশে স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে ‘গণমাধ্যম সাক্ষরতা’ অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও গণমাধ্যম সাক্ষরতা-সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা থেকে শিক্ষার্থীরা সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ফ্যাক্ট চেকিংয়ের কৌশল শিখতে পারবেন।

আরও পড়ুনঃ   বঙ্গবন্ধু , ওআইসি এবং সাম্প্রতিকতা

গুজব ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, সমাজ এবং এমনকি জাতীয় স্তরেও বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাই গুজবের নেতিবাচক প্রভাব থেকে ব্যক্তি, সমাজ ও দেশকে রক্ষা করতে গুজব সম্পর্কে সতর্ক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের ডিজিটাল যুগে গুজব আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার গুজব মোকাবিলায় যা-ই করুক না কেন, এই গুজব থেকে দূরে থাকতে জনগণকেই সবার আগে সচেতন হতে হবে। কোনো তথ্যকে সত্য হিসাবে গ্রহণ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার আগে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে এবং ফ্যাক্ট চ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তথ্যের সূত্র যাচাই করতে হবে। তথ্যের পেছনে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর স্বার্থ আছে কি না, তাও যাচাই করতে হবে। আবার এমন কিছু তথ্য আছে, যা সত্য; কিন্তু তা প্রকাশ করলে সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে— এমন তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত।

বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, তথ্য অধিদফতরের তথ্যবিবরণী ও প্রেস নোট, মূল ধারার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমকে সংবাদের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো তথ্য খুব স্পর্শকাতর মনে হলে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম কিংবা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত অপতথ্য তথা গুজব মনিটরিং ও এর সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তথ্য অধিদফতরের ‘গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল’ এবং ‘ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি’ কাজ করছে। এই ফ্যাক্ট চেকিং কমিটি গুজব প্রতিরোধে নিয়মিত আইকনোটেক্সট ও ভিডিয়ো তৈরি করছে। গুজব প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এসব আইকনোটেক্সট ও ভিডিয়ো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া গুজব প্রতিরোধে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ-সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থা কাজ করছে। এর পাশাপাশি গুজবের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি গণমাধ্যম ও জেলা তথ্য অফিসসমূহ বিভিন্ন প্রচারকৌশল বাস্তবায়ন করছে। গুজব প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর রয়েছে। গুজব প্রতিরোধে গণমাধ্যমকেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনো সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের আগে গণমাধ্যমকে আবশ্যিকভাবে তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে হবে। এর পাশাপাশি গুজব প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করতে হবে।

সরকারের একার পক্ষে গুজব প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। গুজব মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্যের ফ্যাক্ট চেকিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার, গুজব শনাক্তে কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গুজব সৃষ্টিকারীকে শাস্তির আওতায় আনার মাধ্যমে গুজব অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আসুন, আমরা সবাই গুজব প্রতিরোধ করি এবং সত্য প্রচার করি।

লেখক : মো. মামুন অর রশিদ
বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা
(পিআইডি ফিচার)