সৃষ্টির আদি থেকেই নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই পৃথিবী আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে। শ্বাপদসংকুল পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। মন্থর পৃথিবী বেগবান হয়ে উঠেছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকা গতিশীল হয়েছে। মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। নব নব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনে মানুষের বেঁচে থাকা, বিকাশ ও সুরক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সম্পদ অন্বেষণ, আহরণ ও সৃজনের মাধ্যমে পৃথিবীতে সমৃদ্ধি এসেছে, ভূমন্ডল চাকচিক্যময় হয়ে উঠেছে। যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির পরিবর্তন বা উদ্ভাবন সারা পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। পৃথিবী আজ গ্লোবাল ভিলেজের যে নতুন অভিধা পেয়েছে সেটা মূলত সামগ্রিক পরিবর্তনেরই এক মাইলফলক।
কোনো পরিবর্তনই চূড়ান্ত কিংবা স্থিতিশীল নয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি পরিবর্তন নতুন আরেকটি সম্ভাব্য পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন করে। নতুন আঙ্গিকে আরেকটি পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সূত্রপাত ঘটে। প্রকৃতপক্ষে, একটি পরিবর্তন আরেকটি পরিবর্তনের প্রসূতি। পরিবর্তনের মাধ্যমেই সবকিছু উত্তরোত্তর পরিশীলিত ও শানিত হয়ে থাকে, উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। পণ্য ও সেবার গুণগত মান উন্নত হয়, সেবা প্রক্রিয়া সহজতর হয়। মানুষের সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী হয় এবং ভ্রমণের ঝঞ্ঝাট কমে যায়।
পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে ক্রিয়াশীল রাখে। মানুষ নিজে বদলে যাওয়া কিংবা কোনো কিছু বদলে দেয়ার মানসেই নিরন্তর ছুটে চলে, প্রাণান্ত চেষ্টা করে। পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করতে চায়, পৃথিবীতে পদচিহ্ন রেখে যেতে চায়। মানুষ স্বপ্ন আঁকে, অন্যকেও স্বপ্ন দেখায়। এই স্বপ্ন আঁকা কিংবা স্বপ্ন দেখানোর নেপথ্যে মূলত পরিবর্তনেই আকুতিই অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আবহমানকাল থেকে পৃথিবী তাদেরকেই স্মরণে রেখেছে যারা পৃথিবীতে কোনো না কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে মানুষের কল্যাণে যারা ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করেছেন তারাই স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। আগামীতেও পৃথিবী তাদেরকেই স্মরণে রাখবে যারা ইতিবাচক পরিবর্তন সারথি হবে।
পৃথিবীর ইতিহাস মূলত পরিবর্তনেরই স্মৃতিকথা। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়ানুগ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণের জনআকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়েছে। এ জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজন ঐক্য। জাতির যে কোনো বৃহত্তর স্বার্থে সকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা জরুরি। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যতীত জাতীয় কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে জাতীয় লক্ষ্য স্থীর করার ক্ষেত্রে সর্বজনীন স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অতি গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্যের সার্বজনীনতা ব্যতিরেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেবল সমানুপাতিক প্রাপ্তি কিংবা সমানুভূতির প্রত্যাশাই সবাইকে ঐক্যের বন্ধনে বাঁধতে পারে। ঐক্যের ক্ষেত্রে সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া বা সমানভাবে মূল্যায়ন করাটাও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। অধিকন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়া না থাকলে ঐক্য গড়ে ওঠে না।
ঐক্য তৈরিতে নেতৃত্ব সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সুযোগ্য, সুদক্ষ ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ব্যতিরেকে একটি জাতিকে কোনো ইস্যূতে একই প্লাটফর্মে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। নানা সদগুণের সমাহারে নেতৃত্ব হবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নেতা হবে সৎ, প্রত্যয়ী, দূরদর্শী ও দৃঢ়চেতা। সন্দেহাতীত দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলিতে নেতা হবে অনন্য। তার মধ্যে থাকবে বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতা। সকল মত ও পথের মানুষের প্রতি নেতা হবে উদার। কথা ও কাজের সম্মিলনে তাকে মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে নেতা থাকবে অটুট ও অবিচল। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতাকে হতে হবে কুশলি। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতা হবে আপোষহীন। নেতার থাকবে সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যচয়ন, ভাবগাম্ভীর্যতা, মোহনীয় আচরণ এবং আন্তরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নেতা হবে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। একজন নেতা ব্যক্তিগতভাবে হবে নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরহংকারী। অদম্য সাহস, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও সুকঠিন মনোবলের মাধ্যমে লক্ষ্যভেদে নেতা হবে সুনিপুন।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ(বিপিএল)-২০২৫ কে উপলক্ষ্য করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে তারুণ্যের উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এই উৎসবের স্লোগান হলো-‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’। বিপিএল উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তারুণ্যের এই উৎসবের অন্যতম অভিলক্ষ্য হলো দেশ ও জাতির ইতিবাচক পরিবর্তন।
কোনো দেশ বা জাতির ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমী, সৎ ও আদর্শবান নাগরিক। কোনো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছাড়া এরূপ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। জীবনদক্ষতা নির্ভর, কর্মমুখী, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমেই এধরণের নাগরিক গড়ে উঠে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এসমস্ত বিষয়গুলো বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। একটি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক যদি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়াতেই বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তাহলে সেই দেশে সৎ ও আদর্শবান নাগরিক গড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হতে বাধ্য। এরূপে লব্ধ জ্ঞানে কোনো ব্যক্তি সরকারি-বেসরকারি কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পেলে তিনিও বিকল্প পথে রোজগারটা বাড়াতে প্রবৃত্ত হবেন। একটি পরিশীলিত, শুদ্ধ ও জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া জাতির পরিত্রাণ সম্ভব নয়।
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের সামগ্রিক অধঃপতনের মূলে দুর্নীতি। দুর্নীতি গ্রাস করেছে আমাদের সকল মানদন্ড ও মূল্যবোধকে। আমরা বিসর্জন দিয়েছি আমাদের সততা, বিবেক, ইনসাফ, ব্যক্তিত্ব-সবকিছু। এই অবস্থান থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এপ্রসঙ্গে যদিও বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে- এরূপ প্রশ্ন অবান্তর নয়। তারপরও আশাহত হলে চলবে না। সমস্যা যত প্রকটই হোক, সকল সমস্যাই সমাধানযোগ্য। আর দুর্নীতির ক্ষেত্রে আপনি বিদ্রোহী হলেই দুর্নীতি পিছু হটতে বাধ্য। প্রতিটি মানুষই একেকটি স্বতন্ত্র্ ব্যক্তিসত্তা। আমি আমার দায়িত্ব নিই আর আপনি শুধু আপনার দায়িত্বটুকু নেন। কেবল এটুকু করলেই দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এছাড়া আমাদের সমাজের অন্যান্য সামাজিক সমস্যা নিরসনেও আমরা একই পথে সমাধান খুঁজতে পারি।
সকল স্বার্থের উর্ধ্বে দেশ। দেশ ও জাতির স্বার্থকে সর্বদা সমুন্নত রাখতে হবে। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ও লোভ-লালসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ ও জাতির হিতৈষণা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্ন যখন ব্যক্তি অথবা দেশের স্বার্থ তখন দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে। প্রশ্ন যখন দল অথবা জাতির স্বার্থ তখন জাতির স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থে সবসময় আপোষহীন থাকতে হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব, পতাকা কিংবা সংবিধানের মর্যাদার প্রশ্নে কোনোরূপ আপোষকামিতা গ্রহণযোগ্য নয়।
যেকোনো অভিলক্ষ্য পূরণে দলগত স্পৃহা অন্যতম হাতিয়ার। একটি দলের প্রত্যেকটি সদস্য যখন তার দায়িত্বটুকু সফলভাবে পালন করতে পারে, তখন সেই দলের বিজয় সুনিশ্চিত। একক সত্তা হিসেবে আমি-আপনি দুর্বল হলেও সমষ্টিগতভাবে আমরা শক্তিশালী, আমরা অপ্রতিরোধ্য। জাতি হিসেবে আমাদের বীরত্বগাঁথার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা একাট্টা হলেই যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারি। প্রয়োজন শুধু দল-মতের উর্ধ্বে উঠে একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে একই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। তারুণ্যের উৎসব হোক জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি সফল প্রয়াস। এ উৎসবের স্লোগানে উদ্বেলিত হোক বাংলার তরুণ, যুবা, আবালবৃদ্ধবনিতা। এই উৎসব হোক সৃজনশীলতা ও উদ্যমের সম্মিলনে টেকসই জাতীয় ভবিষ্যৎ গড়ার এক মাইলফলক।
লেখক: মো: আবুবকর সিদ্দীক
সিনিয়র তথ্য অফিসার, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
পিআইডি ফিচার