স্মার্টফোনেই মিলবে পাসপোর্ট সেবা

পাসপোর্ট এর বাংলা অর্থ ভ্রমণ নথি। যেখানে এটি বহনকারী সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে। বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এটি ইস্যু করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।এটি বহনকারী ব্যক্তির আন্তর্জাতিক পরিচয়পত্র হিসেবে গণ্য হয়।বিদেশে উচ্চশিক্ষা, ভ্রমণ কিংবা চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য প্রথমেই যে জিনিসটির প্রয়োজন হয় তা হলো পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট করার প্রক্রিয়া অনেকের কাছে জটিল মনে হলেও এটি তেমন জটিল নয়। তবে আগে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য অনেকটা সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হতো।
ই-পাসপোর্ট আবেদনের নিয়মাবলিতে বলা আছে, সবকিছু ঘরে বসে করতে পারলেও নির্ধারিত তারিখে আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দিতে আবেদনকারীকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। শুধু অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা পাসপোর্ট অফিসের বিশেষ সেবা মোবাইল টিমের মাধ্যমে ঘরে বসে বা হাসপাতালে থেকে এ সুবিধা নিতে পারবেন।
পাসপোর্ট কার্যালয়ে দালাল ছাড়া সেবা পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন অনেকেই। সেবাপ্রার্থীরাদের অভিযোগ নিজেরা পাসপোর্টের আবেদন করলে নানা ছুতায় হয়রানি করা হয়। কোনো দালালের শরণাপন্ন হলে সব কাজ দ্রুত হয়ে যায়। এ জন্য গুণতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। এ অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়।
সেবাপ্রার্থীরাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে পাসপোর্ট সেবাকে আরো জনমুখী করার উদ্দশ্যে ইলেকট্রনিক বা ই–পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১১৯তম দেশ হিসেবে ই–পাসপোর্ট চালু করেছে বাংলাদেশ। এখন যে কেউ ঘরে বসে নিজেই নিজের ই–পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ব্যক্তিরা আগাম ভিসা ছাড়া বিশ্বের ৪২টি দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। আগাম ভিসা ছাড়া বাংলাদেশিদের ভ্রমণের এই তালিকায় আছে এশিয়ার ৬টি দেশ। এ ছাড়া আছে দক্ষিণ আমেরিকার ১টি, আফ্রিকার ১৬টি, ক্যারিবীয় ১১টি ও ওশেনিয়ার ৮টি দেশ ও অঞ্চল।কিন্তু সময় বদলেছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়াও এখন সহজ হয়ে উঠেছে।সব থেকে বড়ো কথা হলো, আজকের দিনে ঘরে বসে অনায়াসে আবেদন করা যাবে পাসপোর্টের জন্য। হাতে শুধু স্মার্টফোন থাকলেই যথেষ্ট।
স্মার্টফোনেই হবে সবকিছু। ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্ট (আঙ্গুলের ছাপ), আইরিশ (চোখের মণি)-সহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেওয়া যাবে ঘরে বসে। সব হবে বিশেষ অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে। এরপর যাচাই শেষে প্রিন্ট হবে পাসপোর্ট। এমনকি যথাসময়ে তা পৌঁছে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর ঠিকানায়। বিদ্যমান পাসপোর্ট ভোগান্তি নিরসনে এমন এক সমন্বিত ডিজিটাল উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এটি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরেই এমন স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে।
বর্তমানে পাসপোর্ট পেতে হলে আবেদনকারীকে অফিসে গিয়ে ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়। এ সময় বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে নেওয়া হয় আইরিশ (চোখের মণির ছবি)। তবে নতুন পদ্ধতিতে এর সবকিছুই ঘরে বসে স্মার্টফোনে করা যাবে। এজন্য আবেদনরকারীকে অ্যাপস স্টোর থেকে একটি বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করে নিতে হবে।
এখন স্মার্টফোনে ফেস লক এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট লক সুবিধা রয়েছে। পাসপোর্ট আবেদনের জন্য একই পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিক তথ্য নেওয়া হবে। এতে আবেদনকারীদের পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদনের সঙ্গে ছবি, আঙুলের ছাপ, আইরিশসহ পূর্ণাঙ্গ বায়ো এনরোলমেন্ট সম্পন্ন হবে অনলাইনে। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় স্ক্যান করে আবেদনের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন এবং নবায়ন (রি-ইস্যু) সব ধরনের পাসপোর্ট আবেদন ঘরে বসেই করা যাবে।নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এজন্য ই-পাসপোর্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা জার্মান কোম্পানি ভেরিডোজের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং অনুমোদন থেকে শুরু প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিষয় ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।
উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে পাসপোর্ট সেবার বিদ্যমান চিত্র আমূল বদলে যাবে। তবে এক্ষেত্রে প্রচলিত পুলিশ ভেরিফিকেশন একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা। তাই গণহারে পুলিশি যাচাই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হতে পারে। অপরাধীদের পাসপোর্ট পাওয়া ঠেকাতে পুলিশের অপরাধ তথ্যভান্ডারের (সিডিএমএস) সঙ্গে পাসপোর্টের সর্ভার সংযুক্তির চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া পাসপোর্ট প্রাপ্তির পর কেউ অপরাধ করলে তাকে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টেই ঠেকিয়ে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
পাসপোর্ট একটি নাগরিক অধিকার। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই দেশের যে কোনো নাগরিকের শর্তহীনভাবে পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ব্যাপকভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এতে পাসপোর্ট সেবায় ভোগান্তির মাত্রা বহুগুণ বাড়ে। ভোগান্তি কমিয়ে দ্রুততম সময়ে গ্রাহকের কাছে সেবা পৌঁছাতেইসরকারের এই জনমুখী পদক্ষেপ।পাসপোর্ট সেবা সহজীকরণের অংশ হিসেবে পাসপোর্ট ফরম কিউআর কোডে রূপান্তর করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে স্মার্টফোনের ক্যামেরায় কোড স্ক্যান করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরম পূরণ হয়ে যাবে(ফোনে অটো ফিল ইনফরমেশন চালু থাকলে)। এতে স্বল্প বিনিয়োগে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।ভোগান্তি লাঘবে আবেদনকারীর ঠিকানায় ডাকযোগে পাসপোর্ট পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ডাক বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এখন উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হলেই পাসপোর্ট বুকলেট ডাকযোগে পাঠানো শুরু হবে।
বর্তমানে আবেদনকারীকে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে হাজির হয়ে বুকলেট বুঝে নিতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। এছাড়া ডেলিভারি লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি অহেতুক পাসপোর্ট আটকে রেখে দিনের পর দিন ঘোরানোর ভূরিভূরি নজির রয়েছে। এ সেবা চালু হলে তখন আর গ্রাহকের পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।
বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য পাসপোর্ট ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তা করছে সরকার। রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখায় প্রবাসীদের এমন সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে সৌদিআরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকদের পাসপোর্ট নবায়ন ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনা হতে পারে। পরে পর্যায়ক্রমে অন্য দেশগুলোয় এ সুযোগ দেওয়া হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্কের ই-পাসপোর্ট করতে ফরম পূরণ করে জাতীয় পরিচয়পত্র/স্মার্ট কার্ড এবং ছবি জমা দিতে হয়। এ ছাড়া ১৮-এর কমবয়সিদের জন্য জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট, বাবা-মায়ের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হয়।
ই-পাসপোর্টের সবচেয়েবড়োসুবিধা হচ্ছে, এর মাধ্যমেবিদেশি বিমানবন্দরে ই-গেট ব্যবহার করে খুব দ্রুত ও সহজে ভ্রমণকারীরা যাতায়াত করতে পারবেন। ফলে বিভিন্ন বিমানবন্দরে ভিসা চেকিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে না। এর মাধ্যমেই ইমিগ্রেশন দ্রুত হয় যাবে। ই-গেটের নির্দিষ্ট স্থানে পাসপোর্ট রেখে দাঁড়ালে ক্যামেরা ছবি তুলে নেবে। থাকবে আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের ব্যবস্থাও। সব ঠিক থাকলে তিনি ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেতে পারবেন। কোনো গরমিল থাকলে জ্বলে উঠবে লালবাতি। কারও বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকলে, সেটিও জানা যাবে সঙ্গে সঙ্গে।
পাসপোর্ট সেবায় স্মার্ট ফোনের ব্যবহার গ্রাহকের ভোগান্তি কমিয়ে সময় ও অর্থ বাঁচাতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।

আরও পড়ুনঃ   ফ্যাসিজম ও আগামীর বাংলাদেশ

লেখক: মো. কামাল হোসেন
সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার