সময়ের আবর্তে কাবাডি আর ফুটবলপ্রেমী বাঙালি মজেছে ক্রিকেটের নেশায়। ক্রিকেট এখন নিছক একটি খেলা নয়, বরং জাতির আবেগের আরেক নাম। তাই হালসময়ে এ খেলার প্রতি ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে ‘ক্রিকেট-প্রেম’ এর বদলে ‘ক্রিকেট-উন্মাদনা’ শব্দটিই বেশি শোনা যাচ্ছে। তবে অকপটে স্বীকার করতেই হবে, ক্রিকেটে ওয়ানডে ও টেস্ট-স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের নাম-ডাক অনেকটাই বেড়েছে, খেলাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের সব মহাদেশেই উড়েছে লাল-সবুজের পতাকা। আমাদের ছেলেরা দেশের জার্সিতে যেমন নিয়মিত খেলছে, তেমনি বিশ্বের নামিদামি ক্রিকেট লিগে খেলে দেশের জন্য সুনাম ও সম্মান বয়ে আনছে।
তা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে গতবছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চেয়ারম্যান বা শীর্ষপদে জাতীয় দলে খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে আমরা দেখতে পাইনি। তবে এবারের বিষয়টি ব্যতিক্রম। কারণ, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ১৭তম সভাপতি হয়েছেন ফারুক আহমেদ। পদটিতে বসেই নতুন ইতিহাস গড়েছেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে খেলা প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বোর্ডের সভাপতি হলেন সাবেক এই অধিনায়ক। এর আগে ক্রিকেট মাঠ থেকে উঠে এসে বোর্ডের সভাপতি হয়েছিলেন কেবল কমোডর মুজিবুর রহমান ও আলী আসগর লবি। মুজিবুর রহমান তৃতীয় বোর্ডপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৮১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৩ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। আর আলী আসগর লবি ক্রিকেট বোর্ডের দশম সভাপতি হিসেবে ২৬ নভেম্বর ২০০১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বের ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্রিকেটের এই পদটি সামলেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল গঠনের আগে কমোডর মুজিবুর রহমান ও আলী আসগর লবি কেবল ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন। সেদিকটি বিবেচনায় নিলে জাতীয় দলের হয়ে খেলা পেশাদার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিসিবি সভাপতি হয়ে এক অনন্য নজির গড়লেন ফারুক।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হিসেবে ফারুক আহমেদের কাউন্সিলরশিপ আগেই ছিল। বোর্ড সভাপতি হতে তাকে আগে পরিচালক হতে হতো। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তাকে বিসিবি পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরে বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত পরিচালকদের ভোটে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন সাবেক এই অধিনায়ক। গেলো বছর ২১ আগস্ট বিসিবির দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কয় দিনেই সহকর্মীদের মধ্যে গোছানো ও স্পষ্টবাদী সভাপতি হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন । ক্রিকেটের উন্নয়নে জরুরি কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে করছেন। একইসাথে মাথায় রাখছেন বিসিবির গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের বিষয়টিও। প্রায় সব বিষয়েই সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি।
প্রায় ১৫ বছর ধরে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন ফারুক। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে সফলতম অধিনায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেন। এর ফলে ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে নির্বাচকমণ্ডলী তাকে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনোনীত করেন। কিন্তু তার অধিনায়কত্বে কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দল সেমি-ফাইনালে পৌঁছতে না পারায় দলের বাইরে চলে যান তিনি। পরে অবশ্য দলে ফিরে আসেন ও শীর্ষসারির ব্যাটসম্যানে পরিণত হন। দেশের জার্সি গায়ে খেলেছেন সাতটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ১৫.০০ ব্যাটিং গড়ে মোট রান করেছেন ১০৫। এক ইনিংসে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ সর্বোচ্চ ৫৭ রান। জাতীয় দলে তিনি তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন ১৯৯৯ সালের ২৭ মে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ডানহাতি মাঝ সারির ব্যাটসম্যান হলেও দলের প্রয়োজনে ব্যাটিং উদ্বোধনেও তিনি মাঠে নামতেন। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ফারুক। এছাড়া লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তিনি ২১ ম্যাচ খেলে রান করেছেন ৪৩৭। সবমিলিয়ে দীর্ঘ ১২ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল তার।
ফারুক আহমেদের খেলোয়াড়ি জীবনের উল্লেখযোগ্য বিষয়টি নিয়ে বললে প্রথমেই আসবে ১৯৮৮ সালের ২৯ অক্টোবর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের চতুর্থ খেলার কথা। সে ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়াহিদুল গণি ও আকরাম খানের সাথে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। সে খেলায় তার দল ১৭৩ রানে পরাজিত হয়। ১৯৯০ সালে চন্ডিগড়ে তিনি তার নিজের সর্বোচ্চ ৫৭ রান করেন ভারতের বিপক্ষে। সে খেলায় তৃতীয় উইকেট জুটিতে আতহার আলী খানের সাথে ১০৮ রান করেন তিনি।ক্রিকেট থেকে অবসরের পর দুই দফায় পালন করেছেন জাতীয় দলের নির্বাচকের দায়িত্ব। ২০০৩ থেকে প্রথম দফায় প্রধান নির্বাচক পদে দায়িত্ব পালনকালে অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালকে জাতীয় দলে তুলে আনেন । বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে যে তিন ক্রিকেটার অন্যতম সেরা হিসেবেই বিবেচিত হয়। এরপর ২০১৩ সালে আরেকবার জাতীয় দলের নির্বাচক হন। এ মেয়াদে দলের প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালনকালে তার অধীনেই ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে সাফল্য পায় টাইগাররা। পরে ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয় করে বাংলাদেশ। কিন্তু দল নির্বাচনে বিসিবির হস্তক্ষেপ ও দ্বি-স্তর বিশিষ্ট নির্বাচক কমিটির ফর্মুলার বিরোধিতা করে ২০১৬ সালে সে দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। এবার আট বছর পর ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হয়েই ফিরলেন ফারুক।
ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছে বেশ পরিচিত ফারুক আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। বিসিবির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে ফারুক বলেন, ‘লক্ষ্য অনেক বড়ো। দেশের ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের একসাথে কাজ করতে হবে। আমরা একটি দেশ ও ক্রিকেট প্রিয় জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে চাই। কাজটি সহজ হবে যদি আমরা নিজেদেরকে একটি দল হিসেবে চিন্তা করি এবং আমরা যদি নির্দিষ্ট কাউকে বেশি অগ্রাধিকার না দিয়ে দলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করুক ক্রিকেট দল। আমাদের আরও বড়ো লক্ষ্যের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। তবে ক্রিকেটই হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। দুর্নীতিবাজ প্রক্রিয়ার বিপক্ষে প্রতিবাদ করে আমি বিসিবি থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। আমাদের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, এমন একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে যার মাধ্যমে কোন দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না।’
বোর্ডের নতুন সভাপতি দেশের নারী ক্রিকেটের জন্য নতুন দুইটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন । পুরুষ দলের মতো জাতীয় নারী দলের খেলোয়াড়রা ম্যাচ জিতলেও আর্থিক পুরস্কার হিসেবে পাবেন আর্থিক বোনাস। পাশাপাশি চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরে আরও ৩০ জন থাকবেন বিসিবির সাথে প্রথম শ্রেণির চুক্তিতে। এ দুটি সিদ্ধান্ত দেশের নারী ক্রিকেটকে বহুদূর এগিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করা যায়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া জুলাই বিপ্লবের পরই দেশে আসে পট পরিবর্তন। জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে আজকের নতুন বাংলাদেশ। ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ প্রতিপাদ্যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে তারুণ্যের উৎসব। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৩০ ডিসেম্বর থেকে তারুণ্যের উৎসবের বিস্তৃত কর্মসূচি শুরু হয়েছে। কর্মসূচিগুলো চলবে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত। তারুণ্যের উৎসব ২০২৫-এর লক্ষ্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং বাংলাদেশের বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতির সৌন্দর্যকে উদ্যাপন করা। এরই অংশ হিসেবে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জনপ্রিয় আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের এবারের আয়োজনটি ভিন্ন ধরনের। চলমান আসরের অফিসিয়াল মাসকটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডানা ৩৬’। এটি মূলত ডানা প্রসারিত করা একটি সাদা পায়রার প্রতিকৃতি। মাসকটের নামের ডানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। গত জুলাই-অগাস্টের গণ-আন্দোলনের স্মরণীয় ৩৬ দিনের জন্য মাসকটের দুই পাশে ১৮টি করে রাখা হয়েছে মোট ৩৬টি রঙিন পালক। যা প্রতিটি স্বপ্নবাজ, উদ্যমী, অপ্রতিরোধ্য তরুণকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা দেবে। বিসিবি সভাপতি ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ মাসকট উন্মোচন অনুষ্ঠানে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মোহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক প্রদত্ত মূল শব্দমালা ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ স্লোগানকে ধারণ করে তৈরি করা হয়েছে বিপিএল এর থিম সং।
বিসিবি চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদের হাত ধরেই তারুণ্যের উৎসবের অংশ হিসেবে এবারের বিপিএল পেয়েছে নতুন মাত্রা। তেমনি আপাদমস্তক একজন খেলোয়াড়, ক্রীড়াসংগঠক ও ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ফারুকের নেতৃত্বেই দেশের ক্রিকেট ব্যবস্থাপনায় আসতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন, ক্রীড়াক্ষেত্রের সফলতার মুকুটে যুক্ত হতে পারে নতুন নতুন পালক। সেই আশাতেই নতুন বাংলাদেশে আমাদের পথচলা।
#
লেখক: ম. জাভেদ ইকবাল,সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার
পিআইডি ফিচার
ফারুক আহমেদ : বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেতৃত্বে নতুন যুগের সূচনা
