কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন

কর্মজীবী মায়েদের ছোটো সন্তানদের নিরাপদ দিবাকালীন সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাদের নিশ্চিন্তে এবং নিরাপদে আয়বর্ধকমূলক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারিভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের সুষম ও ধারাবাহিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। নারীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করে কর্মমুখী করতে পারলে তাদের সম্ভাবনা ও কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চ্যালেঞ্জিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীরা সাফল্যের সাথে চাকুরি করে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তাদের শিশু সন্তানদের জন্য উপযুক্ত ডে-কেয়ার সেবা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বর্তমানে ‘২০টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় বর্তমানে মোট ৬৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি ডে-কেয়ারে আসন সংখ্যা ৫০-৮০টি। এছাড়া, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কিছু ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপিত রয়েছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত শিশু দিবাযত্ন কর্মসূচির আওতায় কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের (০৬ মাস হতে ০৬ বছর পর্যন্ত) দিবাযত্ন কেন্দ্র থেকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে স্ব স্ব কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। শিশু দিবাযত্ন কর্মসূচির আওতায় রাজস্ব খাতভুক্ত মোট ৪৩টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে থাকে।
জাতীয় মহিলা সংস্থা কমপ্লেক্স সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন শীর্ষক সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে ২০০২ সালে ৫০ টি আসন বিশিষ্ট একটি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করা হয়। ডিসেম্বর ২০০৯ এ প্রকল্প সমাপ্তির পর সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগে ডে-কেয়ার সেন্টারটি চালু রয়েছে। বর্তমানে ১৭ জন শিশু ডে-কেয়ার সেন্টারে ভর্তি আছে। এ সেন্টারের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২৪২ জন শিশুকে লালন পালন করা হয়েছে।
কর্মজীবী মায়েদের ছোটো শিশু সন্তানদের দিবাকালীন দেখাশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, ছবি আঁকা, অক্ষর পরিচিতি, ছড়া শেখা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সেন্টারে এক থেকে ছয় বছরের শিশুদেরকে রাখা হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায় সার্বক্ষণিক একজন ইনচার্জের অধীনে একজন শিক্ষিকা কাম স্বাস্থ্য সহকারী ও দুইজন আয়া কর্মরত রয়েছে। শিশু ভর্তি ফি ১৫০০/- টাকা এবং মাসিক বেতন ৮০০/-টাকা। শিশুরা বাড়ি থেকে যার যার খাবার নিয়ে আসে এবং সেন্টারটিতে গোসলের কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতি কর্মদিবসের সকাল ৮.৩০ মি. হতে বিকাল ৬.০০ মি. পর্যন্ত ডে-কেয়ার সেন্টারটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কেন্দ্রে একজন অভিভাবকের দুইটির বেশি শিশু ভর্তি করা যাবে না। কেন্দ্রে ভর্তির জন্য নির্ধারিত ভর্তি ফরমে আবেদন করতে হবে। শিশুর সঙ্গে কোনো মা/অভিভাবক/গৃহকর্মী কেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবে না। সাময়িক অসুস্থ ও ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত শিশুকে নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত ডে-কেয়ার সেন্টারে আনা যাবে না। শিশুদের জন্য দিবাকালীন বিশ্রামের ব্যবস্থাও রয়েছে।
জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়িত গার্মেন্টস ও কারখানার নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার (২০টি সেন্টার) কর্মসূচির আওতায় প্রতি মাসে প্রতিটি সেন্টারে ৩০ জন করে ২০টি সেন্টারে ৬০০ জন শিশুকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, অক্ষরজ্ঞান দান, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণসহ দিবাকালীন সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে গার্মেন্টস ও কারখানায় কর্মরত মহিলা শ্রমিকরা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে তাদের ৪ মাস থেকে ৬ বছরের সন্তানদের নিরাপদ পরিবেশে, বিনামূল্যে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে সকাল ৮.০০ থেকে রাত ৬.০০ পর্যন্ত নিরাপদ পরিবেশে সযত্নে দেখা শোনার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া শিশুদের মাঝে স্বদেশ প্রেম, নৈতিক শিক্ষা, শৃঙ্খলা, জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাক শিক্ষাদানের মাধ্যমে বিদ্যালয়মুখী করা হয়।
কর্মজীবী মায়েরা শিশু সন্তানদের নিরাপদ স্থানে ও সুন্দর পরিবেশে ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে নিশ্চিন্ত মনে কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। তাছাড়া ডে-কেয়ার সেন্টারে অনেক শিশুদের সঙ্গে একসাথে থাকার ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যথাযথভাবে হয়ে থাকে। কিন্তুকর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান ডে-কেয়ার সুবিধা প্রয়োজন এর তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। উল্লেখ্য যে, কর্মজীবী মহিলাদের সন্তানদের জন্য দেশের সকল জেলা সদরে একটি করে ডে-কেয়ার সেন্টার এবং ঢাকা শহরসহ সকল মেট্রোপলিটন শহর ও নারায়নগঞ্জে প্রয়োজনানুসারে একাধিক ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর প্রতি সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। কর্মজীবী নারীদের শিশু সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সুবিধার ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে ৬০ টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে যা সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত শ্রম আইনের আওতায় পড়ে না যেসকল কর্মজীবী মা তাদের সন্তানদের (৪ মাস থেকে ৬ বছর) নিরাপদ দিবাকালীন সেবা প্রদান করা হবে।
এ কার্যক্রম জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৬ পর্যন্ত এবং এতে ব্যয় হবে প্রায় ২১১ কোটি টাকা। ভাড়া বাড়িতে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের চিন্তা করা হয়েছে, তবে সরকারি/বেসরকারি দপ্তরে স্থান সংকুলান হলে সেখানে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হবে । এতে কর্মজীবী মায়েদের ছোটো শিশুদের (৪ মাস থেকে ৬ বছর বয়সি) নিরাপদ দিবাকালীন সেবা প্রদান করা হবে এবং শিশুদের জন্য সুষম পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশসহ প্রাক-স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, প্রি-প্রাইমারী শিক্ষা, অক্ষরজ্ঞান, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করার সুযোগ থাকবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন এর মাধ্যমে কর্মরত নারীদের কর্মস্থলে মনোযোগ নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ ভূমিকা রাখবে।
শিশুসন্তানের নির্ভরযোগ্য ডে-কেয়ার সুবিধা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সম্প্রসারিত করে। ফলে, এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। সার্বিকভাবে প্রকল্পটি নারী উন্নয়ন, দারিদ্র্যমোচনসহ দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করার জন্য যে ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- নারীর অগ্রগতির জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, নারীদের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও সহায়তামূলক সেবা নিশ্চিত করা। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছাড়াও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (এসডিজি) সমূহের সাথে সম্পৃক্ত রেখে এ প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এসডিজির ৫ নং গোল “লিঙ্গ সমতা” এর নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক মন্ত্রণালয় হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উন্নয়নে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণের সহায়ক সেবা হিসেবে কর্মস্থলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করার বিষয়টি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া, ঢাকাসহ সকল মেট্রোপলিটন শহরে প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন/নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, নারী যেখানে অধিক সংখ্যায় কর্মরত আছেন, সেখানে দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। একইসাথে, উক্ত নীতিতে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সুবিধা প্রদানের জন্য কর্মস্থলে দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত নীতিমালা ও কর্মস্থলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন বিষয়ক সরকারি নির্দেশনার আলোকে যে সকল এলাকায় এখনও ডে-কেয়ার সেন্টার নেই, জনবহুল এলাকা, নারীর কর্মসংস্থান বেশি ও যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধাজনক সে সকল স্থানকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
বর্তমানে কর্মরত নারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মজীবী মায়েদের জন্য নিশ্চিন্তে এবং নিরাপদে কাজ করার সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্মজীবী মায়েদের ছোটো শিশুদের জন্য নিরাপদ দিবাকালীন সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকে। শিশুদের নিরাপদ দিবাকালীন সেবার নিশ্চয়তা কর্মজীবী মায়েদের কাজে অংশগ্রহণ ও পূর্ণ মনোযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেশের ৮টি বিভাগের আওতায় ৪৫টি জেলায় ৬০টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হবে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য দিবাকালীন সেবা প্রদানের সুযোগ প্রসারিত হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি শিশুর সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করবে।

আরও পড়ুনঃ   দারিদ্রমোচনে সামাজিক সুরক্ষা : আমিনুল ইসলাম

লেখক: মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়