জনস্বার্থে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে

ইমদাদ ইসলাম : দেশের জনসাধারণের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টেকসই, নিরাপদ, লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০, জাতীয় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নীতি ২০২০, বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা ২০২০, জাতীয় কৃষি বিপণন নীতি ২০২৩ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে কৃষিখাতের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে চলমান বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। এই ধারা অব্যাহত রেখে ভবিষ্যতের বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য সরকার স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে নকৃষিখাতের অবদান জিডিপির কম-বেশি ১৪ শতাংশ। পাশাপাশি, শ্রমশক্তির ৪১ শতাংশ মানুষের জীবীকা এ খাতের ওপর নির্ভরশীল ।

কৃষি উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। খাদ্য উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান ও অসাধুতা এবং বাজারজাতকরণ ও বিপণনে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য যোগানে অনেক পিছিয়ে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিসম্মত খাদ্য সরবরাহ ও প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশ, কৃষি নির্ভর শিল্পের প্রসার, কৃষিজ পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা ও কৃষি ঋণের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তির পদ্ধতি সহজতর করা হয়েছে।সরকারের পক্ষ থেকে  দেশজ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কৃষকদের সহায়তা প্রদানের জন্য সার ও অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ স্থান থেকে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। উপরন্তু, বাংলাদেশ এখন দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম স্থানে রয়েছে। কৃষি উৎপাদন বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।

বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন ও সম্পদ হ্রাস থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং আন্তঃসংযুক্ত সমস্যাগুলির একটি জটিল সংযোগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই চ্যালেঞ্জগুলি সকলের জন্য নিরাপদ, পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করার পথে প্রবল বাধা তৈরি করছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ধান ও ভুট্টাসহ সকল প্রকার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তা দ্রুততার সাথে সম্প্রসারণ করা দরকার । এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে  জীব প্রযুক্তির মাধ্যমে বীজ উন্নয়ন ও বর্ধিতকরণ, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি ও সেচ কাজে সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জৈব সারের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির উপর গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। সকল কৃষককে স্মার্ট কার্ড প্রদান, ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান ই-কৃষি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে সার ও বীজসহ কৃষি উপকরণের মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) অব্যাহত রাখা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের নিকট পৌঁছানো, ‘সমলয় চাষাবাদ’ সম্প্রসারণ, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও টমেটোসহ বিভিন্ন সবজি ও ফল উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণে সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। পতিত জমির ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষিসেবা সহজে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘কৃষি বাতায়ন’ চালু রাখার পাশাপাশি ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষিতথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্ৰ (এআইসিসি) স্থাপন করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ   ‘পুষ্টি ক্লিনিক’: পুষ্টি বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অনন্য উপাদান

এছাড়া, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষিপ্রযুক্তি ভাণ্ডার, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, কমিউনিটি রুরাল রেডিওসহ বিভিন্ন মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে কৃষকদের দোরগোঁড়ায় কৃষিতথ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। অনলাইন কৃষি মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম ‘হর্টেক্স বাজার’ এবং ‘ফুড ফর নেশন’ চালু করা হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকেরা তাদের ফসলের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কৃষিখাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি, সার-বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণে প্রণোদনা ও সহায়তা কার্ড, সেচের মূল্য হ্রাস, হ্রাসকৃত ভাড়ায় কৃষিপণ্য পরিবহণ, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা, স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে বিশেষ কৃষি ঋণ সুবিধা প্রদান অব্যাহত রয়েছে।

গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স জি এইচ আই) ২০২৩)  অনুযায়ী, বিশ্ব ব্যাপী ক্ষুধা একটি মাঝারি পর্যায়ে রয়েছে। তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বলতে এমন পরিস্থিতিকে বোঝায় যখন কোনো ব্যক্তির পর্যাপ্ত খাবার কেনার সামর্থ্য থাকে না। আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা নেই। তবে বিগত দশকে দেশে খাদ্যব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দারিদ্র্যপীড়িত ও দুস্থ পরিবারগুলোর জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পুষ্টিকর নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে আমরা ইতোমধ্যে ধানভিত্তিক খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। তবে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করা এখন আমাদের জন্য  নতুন চ্যালেঞ্জ। ক্ষুধা নিয়ে বাংলাদেশে আপাতত কোনো দুশ্চিন্তা নেই ঠিকই, কিন্তু চিন্তা এখন অদৃশ্য ক্ষুধা বা অপুষ্টিকে ঘিরে। দেশের কৃষক প্রতিবছর প্রায় চার কোটি টন চাল উৎপাদন করছেন। অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্ত্বেও এটি আমাদের বিশাল সাফল্য। কিন্তু খাদ্য হিসেবে আমাদের শুধু কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা খেলে চলবে না, প্রয়োজন সুষম খাদ্য। সুষম খাদ্য বলতে আমরা বুঝি শর্করা, আমিষ, স্নেহ, খনিজ লবণ, ভিটামিন ও পানি সবকিছুর সম্মিলন। সুস্থ ও নিরোগ থাকার জন্য আমাদের নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ করা দরকার।

আরও পড়ুনঃ   নারীর ক্ষমতায়ন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

এ দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জমির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম থাকায় প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জন্য খাবার নিশ্চিত করা সরকারের জন্য এখন বড়ো চ্যালেঞ্জ। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে মজুদ ভাণ্ডার বাড়াতে হবে। এখন ২২.৭৬ লাখ টন খাদ্য মজুদের সক্ষমতা আছে।সরকার এটাকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ টনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে । দেশে সাতটি সাইলো গুদাম নির্মাণাধীন রয়েছে। এগুলোর প্রতিটিতে প্রায় ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য রাখা যাবে।

আমাদের বছরে তিন কোটি ৭৫ লাখ টন চাল এবং ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। উদ্যমী কৃষক ও সরকারের সহায়তায় চাল উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন আমদানি করে খাদ্যঘাটতি মেটানো হয়। চলতি বছর ১০ লাখ টন গম উৎপাদন হয়েছে। ফলে বাকি ৬০ লাখ টন আমদানি করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিখাতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বড়ো নেটওয়ার্ক আমদানি কাজে যুক্ত আছে। খাদ্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে চাল ও গমসহ কয়েকটি পণ্য আমদানির জন্য সরকার কর ও শুল্ক তুলে নিয়েছে। এতে বেসরকারি আমদানিকারকরা উৎসাহিত হচ্ছেন।

কৃষি উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। খাদ্য উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান ও অসাধুতা এবং বাজারজাতকরণ ও বিপণনে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য যোগানে অনেক পিছিয়ে। এই সমস্যা সমাধানে কৃষির উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিক কৃষি উপকরণে যোগান বাড়াতে হবে। কাজ করতে হবে বাজারজতকারণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতিতে।
#
পিআইডি ফিচার