ক্রিকেট পাগল জাতি আমরা। প্রতিটি তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীর শরীর ও মনে ক্রিকেট উম্মাদনা যেন লেগেই আছে সারাক্ষণ। দিন যাচ্ছে, ক্রিকেটের ধরন পাল্টাচ্ছে সময়ের তালেতালে। পাঁচদিনের টেস্ট ক্রিকেট যেন ম্লান হতে চলেছে। একদিনের ম্যাচও অধৈর্য ধরিয়ে দিচ্ছে আমাদের। ব্যস্ততম বিশ্বে সময়কে তাড়া করে ফিরতে আমরা ঝুঁকছি অল্প সময়ের বিনোদনের দিকে। আমাদের এই মনের বাসনা পূরণ করতে হাজির হয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। কুড়ি ওভারের এই ম্যাচে দুপক্ষের শক্তি আর সামর্থ্য ফুটে উঠছে মাঠে, গ্যালারিতে আর টিভির পর্দায়। ক্রিকেটকে ছাপিয়ে বিনোদনের ছড়াছড়ি এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের ম্যাচে। এখানে কেবল ক্রিকেটারের নৈপুন্যের ফ্রেমে আবদ্ধ নেই বিনোদন। উপরন্তু ব্যবসা, বিজ্ঞাপন, ফিল্মস্টার সকলেই একটি ছাতার নিচে একত্রিত হয়ে বিনোদন ছড়াচ্ছেন।
প্রতি শীত মৌসুমে বাংলাদেশে নিয়ম করে টি-টোয়েন্টির আসর বসে আসছে। তবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হতেযাওয়া টি-টোয়েন্টি আসর একটি ভিন্ন মাত্রা পেতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া জুলাই বিপ্লবের পরই দেশে আসে পট পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দুঃশাসনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে দেশের মানুষ। সেই জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করেই এবার নির্মিত হলো ঘরোয়া ক্রিকেটের জনপ্রিয় আসর আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের অফিসিয়াল মাসকট। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডানা ৩৬’। এটি মূলত ডানা প্রসারিত করা একটি সাদা পায়রার প্রতিকৃতি। ১ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচিত হয় দেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের মাস্কটটি। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ফারুক আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন মাস্কট ‘ডানা ৩৬’ এর। একই দিনে সূচিত হলো ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’ এর আনুষ্ঠানিক পথচলা। দেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের আগের দশ আসরে ছিল না কোনো মাসকট। বিপিএলের ১১তম এই আসরের মাসকটের সাথে থাকছে থিম সং।
৩০ ডিসেম্বর শুরু বিপিএল দিয়ে যাত্রা করে তারুণ্যের উৎসবের শেষটা হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠেয় অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলের ফাইনাল দিয়ে। আয়োজনটি মূলত তরুণদের জন্যই। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই আয়োজনের ঘোষণা দেন। সে হিসেবে তারুণ্যের উৎসবের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে এবারের বিপিএল দিয়েই। আগামী ৩০ ডিসেম্বর বসছে বিপিএলের নতুন আসরটি।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ ১২টির বেশি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রায় দুই মাস ধরে চলবে এই তারুণ্যের উৎসব। ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস ও বাস্কেটবলের নানা আয়োজন থাকছে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হতে যাওয়া এই তারুণ্যের উৎসবে। গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের ছাপ থাকবে এই আয়োজনের পরতে পরতে।
অনুষ্ঠেয় বিপিএলের মাসকটের নামের ডানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। গত জুলাই-অগাস্টের গণ-আন্দোলনের স্মরণীয় ৩৬ দিনের জন্য মাসকটের দুই পাশে ১৮টি করে রাখা হয়েছে মোট ৩৬টি রঙিন পালক। যা প্রতিটি স্বপ্নবাজ, উদ্যমী, অপ্রতিরোধ্য তরুণকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে। বিসিবি সভাপতি ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মোহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক প্রদত্ত মূল শব্দমালা ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ স্লোগানকে ধারণ করে তৈরি করা হয়েছে সেই থিম সং। তারুণ্যের উৎসবের প্রতিপাদ্যও এই স্লোগান।
বিপিএলে এবার মাঠে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের জন্য থাকবে বিনামূল্যে পানির ব্যবস্থা। আন্দোলনে প্রাণ দেওয়া মীর মুগ্ধের নামে ‘শহীদ মুগ্ধ কর্নার’ থেকে বিনামূল্যে পানি পান করতে পারবেন দর্শকরা। সেখানে থাকা কিউআর কোডের মাধ্যমে জুলাই ফাউন্ডেশনে অনুদানও দিতে পারবেন ইচ্ছুক যে কেউ। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ ও রিসাইক্লিং বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিটি ভেন্যুতে থাকবে বর্জ্য-শূন্য জোন। যেখানে প্রচার করা হবে বর্জ্য-শূন্যতার উপকারিতা। পাশাপাশি দর্শকদের ভোগান্তি কমাতে বিপিএলের সব টিকেট অনলাইনে বিক্রির ব্যবস্থা করার চেষ্টাও করছে বিসিবি।ক্রিকেটপ্রেমীদের পাশাপাশি সারা দেশের আপামর মানুষের মাঝে তারুণ্যের উৎসব ছড়িয়ে দিতে বিপিএলের তিন ভেন্যু ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ‘মিউজিক ফেস্ট’ নামে আয়োজন করা হবে তিনটি কনসার্ট। এর বাইরে আরও কিছু চমকের আভাসও দিয়ে রাখেন বিসিবি প্রধান।
বিপিএল চলাকালে প্রতি শুক্র ও শনিবার একটি করে ছেলেদের মোট আটটি ও মেয়েদের আটটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করা হবে। এছাড়া অনূর্ধ্ব-১৫ ন্যাশনাল কাপের আয়োজন করা হবে। পরে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে পর্দা নামবে তারুণ্যের উৎসবের। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পাশাপাশি তারুণ্যের উৎসবের অংশ হিসেবে প্রতিভা অন্বেষণে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, আন্তঃ স্কুল ও কলেজ প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, স্কিল প্রতিযোগিতা ও জুলাই-৩৬ বিষয়ক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়া যুব ও উদ্যোক্তা সমাবেশ , বিভিন্ন কর্মশালা, জনসচেতনতা বিষয়ক কার্যক্রম, আর্ট গ্যালারিতে জুলাই বিপ্লবের চিত্র প্রদর্শনী, অনুদান ও বৃত্তি প্রদান, বর্জ্য-শূন্যতা প্রচারে চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার প্রদান, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্পেইন, কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টি বিষয়ক অলিম্পিয়াডসহ থাকছে আরও বেশ কিছু আয়োজন।
বিপিএলের অফিসিয়াল মাসকট উন্মোচন অনুষ্ঠানের শেষাংশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই তারুণ্যের উৎসবের মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র সংস্কারের বার্তা দেন ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, “খেলাধুলা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। বিশেষ করে ক্রিকেট সবসময়ই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। ভিন্ন ক্ষেত্রে যত মতবিরোধই থাকুক, খেলার ক্ষেত্রে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাই। জাতীয় ঐক্য বজায় রেখে দেশ পুনর্গঠন ও রাষ্ট্র সংস্কারে এগিয়ে যাওয়াই এই তারুণ্যের উৎসবের অন্যতম উদ্দেশ্য।”আশা করা যায়, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের একটা বড়ো প্রেরণা হয়ে উঠবে এই তারুণ্যের উৎসব ।
ম. জাভেদ ইকবাল
লেখক: সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পিআইডি, ঢাকা
পিআইডি ফিচার