আন্দোলন সংগ্রামসহ পৃথিবীর সকল লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি অবদান
ছিল নারীদের। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমরা আমাদের
নারীদের দেখেছি। তাঁদের রাগে কাঁপতে দেখেছি, দুঃখে কাঁদতে দেখেছি, চরম দুঃসময়ে সহায়তার হাত
বাড়াতে দেখেছি, আহত হতে দেখেছি, শুশ্রূষা করতে দেখেছি। প্রতিবাদী কন্ঠ শুনেছি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে দেশের সব স্তরের নর-নারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরিক হয়েছিলেন।
ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে তাতেও অংশ নেন নারীরা। ভাষা
আন্দোলনের এসব বিপ্লবী নারীর নাম ইতিহিাসরে পাতায় লেখা হয়ে গেছে। বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিক এবং
দার্শনিকদের গবেষণায় দেখা যায়, সমাজ এক সময় মাতৃতান্ত্রিক ছিল। আদিম যুগের বড়ো সময়জুড়ে
নারীরা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করত। ওই সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং হেনরি লুই
মর্গানের আদিম সমাজসহ আরও বিভিন্ন গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা দেখা যায়।
আদিমকালে সমাজ উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় মানুষ এক সময় সভ্য জগতে প্রবেশ করে। সভ্য
সমাজের পূর্বে বড়ো সময়জুড়ে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে অস্তিত্ব রক্ষা করে। ওই সময়
কার্যত নারী-পুরুষের মধ্যে খুব একটা বিভক্তি ছিল না।
মর্গানের মতে, নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে পরিবার বিকশিত হয়েছে। ঐতিহাসিকদের
ধারণা নারীর পরিচয়ে সন্তান বড়ো হতো। পাশাপাশি, একই সময় কৃষি নিয়ন্ত্রণ করত নারীরা। সন্তান
জন্ম ও লালনের সময় পুরুষের সাথে নারী শিকারে যাওয়া থেকে বিরত থাকত। নারী ওই অবসরে সে
কৃষিকাজ আবিষ্কার করে। আহরিত ফলমূলের বীজ থেকে যে শস্য উৎপাদিত হয়, তা প্রথম নারীই
খেয়াল করে। ফলে মানব ইতিহাসে কৃষিকাজ নারীর হাত ধরে বিকশিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস এর ২ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে আগুন ঝরা
কন্ঠ "আমার ছাত্রের মুখ চেপে ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে"? "আমার ছাত্রের কলার ধরার
সাহস কে দিয়েছে আপনাকে"?। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী কন্ঠ শুনেছি তারা বলছে "আমাদের একটা
মেধা পড়লে ১০ কোটা গিলে খাবো। গিলে খাবো মানে গিলে খাবো"। বাবাকে বলা কন্যার কথাগুলো "
বাবাকে বলে আসছি যদি মরে যাই,বিজয়ের পরে যেন আমার লাশ দাফন করে"। অনেকের কন্ঠে ছিল
প্রতিবাদী গান।
এক মা পথের ধারে পানি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের পানি
দিচ্ছেন আর বলছিলেন 'বাবা আমি অসুস্থ তোমাদের সাথে যেতে পারছিনা। তোমাদের জন্য দোয়া
করছি, বিজয়ের বেশে তোমরা ফিরে আসবে'। এই প্রতিবাদী কন্ঠ,মায়ের ব্যকুলতা বাংলার মানুষের
বিবেককে নারা দিয়েছিল, তাইতো সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছিল বিজয় ছিনিয়ে নিতে।
নারীকে বিজয়ে উল্লাস করতে দেখেছি। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন কিংবা
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ২০২৪ সালের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেখা মিলেছে নারী শিক্ষার্থী, শিক্ষিকা, গৃহিণীদের। ৫ আগস্ট
সরকার পতনের অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে নারীরা।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ একে আরও বেগবান করেছিল, লক্ষ্য অর্জন
ত্বরান্বিত করেছিল। নারীর অংশগ্রহণের আমাদের আন্দোলনের যে অতীত ইতিহাস, তা এবার ভেঙে
গিয়েছিল। কারণ, সমাজে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ঘর থেকে। দীর্ঘমেয়াদে শোষণের যে গল্প, যে
পুঞ্জীভূত ক্ষোভ জমা হয়েছিল, তা ছুঁয়ে ফেলেছিল বাড়ির আঙ্গিনায়। এ আন্দোলনে স্ফূলিঙ্গ
জ্বালিয়েছে শাড়ির আঁচল। ফলে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরাও। আর এই ঘুরে দাঁড়ানোটা ছিল অর্থবহ।
আন্দোলনে কিশোরীরা সব সময় ছিল সম্মুখ সারিতে। জীবন দিয়েছে তারা। সরকার পতনের দিন ৫
আগস্ট পুলিশের গুলিতে সভারে থানা রোডে মারা যায় নাফিসা। একই দিন বেলা ১১ টায় মিরপুর ২
নম্বর ওভারব্রিজের নিচে পুলিশের ছোড়া গুলি মাথায় বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় রিতা আক্তারের।
সিদ্ধেশ্বরী নিউ সার্কুলার রোডে ১৪ তলার বারান্দায় ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে
নিহত হন গৃহকর্মী লিজা আক্তার। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে আরও নিহত হন নারায়ণগঞ্জে
বাসার ছাদে ছয় বছর বয়সি রিপা গোপ, উত্তরায় চারতলার বারান্দায় নিহত হন দশম শ্রেণির
শিক্ষার্থী নাইমা সুলতানা । ২১ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি বারান্দা দাড়িয়ে
থাকা সুমাইয়া সুমির মাথায় লাগে। সেখানে ঢলে পড়েন তিনি। ৫ আগস্ট টঙ্গীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থী
নাফিসা হোসাইন মারওয়া নিহত হন। ২ টার সময় বুকে গুলি লাগে তার। বুকে গুলি বিদ্ধ মারওয়া সোয়া
২টার দিকে বাবাকে ফোন করে বলে, ‘আব্বু আমি মরে যামু। লাশটা নিও।’ এটাই মারওয়া শেষ কথা।
জাতির মুক্তি ও জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে নারীরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই সম্পৃক্ত
ছিলেন। তাঁরাও যুদ্ধ করেছেন। বিপ্লবী নারীদের পথ ধরেই এসেছে নারীমুক্তি আন্দোলন। কোটা
সংস্কারের দাবি থেকে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতনের অভ্যুত্থানে পরিণত
হওয়া আন্দোলনে নারীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ ছিল। লাখো নারী পথে নেমেছিলেন। হাজারো মা
তাদের সন্তানদের নিয়ে মিছিলে পা বাড়িয়েছিলেন। অনেক মাকে দেখেছি পানি নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে
পান করাচ্ছে আন্দোলনে যোগ দেয়া সন্তানদের। এমনও মাকে দেখেছি ভাত মেখে রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে
শিক্ষার্থীদের মুখে ভাত তুলে দিতে। সন্তানদের নিরাপত্তায় পাশে দাড়ানো, আন্দোলনে সন্তানদের
শক্তি যোগাতে নিরন্তন প্রচেষ্টা। আমরা এই পুরো আন্দোলনে এমন হাজারো চোখ ভেজানো দৃশ্য
দেখেছি। দেখেছি সন্তান কোলে মায়েদের পতাকা হাতে উল্লাস। পৃথিবীর ইতিহাসে যত অভ্যুত্থান
হয়েছে ২০২৪ এর অভ্যুত্থানে মাদের ব্যকুলভাবে অংশগ্রহণ পৃথিবী এর আগে দেখেনি।
আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং তৎকালীন সরকারের সশস্ত্র
সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়েছে শতাধিক কিশোরী-তরুণী। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছাত্রীদের বেধড়ক পেটায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা, সেদিন রাজপথ
রক্তাক্ত হয়েছিল ছাত্রীদের রক্তে যা ছিল নজিরবিহীন।
এই হামলার পরই কোটা সংস্কার আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের
বন্দুকের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে আত্মাহুতি দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
আবু সাঈদ। সেদিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বন্ধ ঘোষণা করলেও ১৮ জুলাই
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনতা রাজপথে নামে, এর বড়ো অংশই ছিল
নারী। যা বাংলাদেশের রাজপথে আগে কখনও দেখা যায়নি। নারীদের নজিরবিহীন অংশগ্রহণেই শেখ
হাসিনার পতন অসম্ভব থেকে সম্ভব হয়েছে। কিশোরগঞ্জে শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে ১৮ জুলাই
দুপুরে রাজপথে নামেন মাহিরা আক্তার ইকরা। শহরের গৌরাঙ্গবাজার সেতু এলাকায় পৌঁছালে মিছিলটি
ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখে পড়ে। ছাত্রলীগের ২০ থেকে ২৫ জন সন্ত্রাসী হাতে রামদা, ছুরি, অস্ত্র
দিয়ে মিছিলে হামলা করে। ঐ হামলায় ইকরাকে কুপিয়ে আহত করে।
শুধু মায়েরা নন। নারী শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, উদ্যোক্তাদের দেখেছি। নারী সাংবাদিকদের
দেখেছি। সবার একটিই চাওয়া ছিল—যথেষ্ট হয়েছে, আর না। এই আন্দোলন আমাদের জানিয়ে দিল,
পুরুষের হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়াই জেন- এই প্রজন্মের নারী এবং মায়েদের
চাওয়া। দেখিয়ে দিল, অর্ধেককে সুযোগ দিলে পূর্ণ হওয়া যায়। তাতে লক্ষ্য অর্জন ত্বরান্বিত হয়।
স্বাধীনতা আমাদের হয়নি, একটি স্বাধীনতাকে স্বাধীন করা হয়েছে। এতদিন স্বাধীনতা শুধু পুস্তক
আর সাহিত্যে বাক্সবন্দি ছিল। রক্তের বিনিময়ে উন্মুক্ত করেছে সেই স্বাধীনতাকে ২০২৪ এ। এটি
শুধু চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলন ছিল না; এটি মূলত বিগত ১৫ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ, শোষণ-
শাসনের ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর।
আই হেইট পলিটিক্স' বলা জেনারেশন যেভাবে দেশের ইতিহাস পাল্টে দিল তা অবিশ্বাস্য।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অভিনব অভ্যুত্থান হয়েছে যাকে বিপ্লবের মর্যাদা
দেয়া হয়েছে।
লেখক: মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন,সিনিয়র তথ্য অফিসার
পিআইডি ফিচার