সমতা, ন্যায্যতা, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের অন্যতম
প্রধান ভিত্তি পাকাপোক্ত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির
উন্নয়ন সম্ভব নয়। কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা । শিক্ষার
গুণগত মান বৃদ্ধি করতে গেলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান
পর্যাপ্ত। অভাব শুধু গুণগত বা মানসম্মত শিক্ষার। শিক্ষার মান বাড়বে শিক্ষকদের গুণে।
শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন মানুষের জীবনে মা-
বাবার পরে জীবন গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে তার শিক্ষক। শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে
শিক্ষকদের অবদান অসামান্য। দেশে শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ অনেকখানি হয়েছে বটে, তবে গুণগত
উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর গুণগত যোগ্যতা অর্জনের
মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থাও প্রাথমিক শিক্ষার মতো। শিক্ষার্থীর
সংখ্যা ও হার ক্রমেই বাড়লেও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ ভীষণভাবে পিছিয়ে
রয়েছে। দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বস্তুতপক্ষে সর্বস্তরের
শিক্ষাতেই তাত্ত্বিক ধারা প্রাধান্য বিস্তার করছে, যা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তির বিষয় নয়। এ
ক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনে শিক্ষকদের বড়ো ভূমিকা রয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সবারমধ্যে পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধি ও অধিক জিপিএ-প্রাপ্তি নিয়ে
বেশ গর্ব ও স্বস্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে যদি শতভাগ পাস বা শিক্ষার পরিবর্তে
মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষার ওপর যথাযথ গুরুত্বারোপ করত, তবে তা দেশ, জাতি ও ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করত। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ
শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে, তখন
স্বভাবতই শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি শিক্ষার্থীদের মানসম্মত ও গুণগত
শিক্ষা দিতে পারছি, না-কি একটি বিশাল গলদ রেখে সামনে অগ্রসর হচ্ছি! শিক্ষা একটি দেশের
উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। যে দেশে শিক্ষার হার ও গুণগত মান যত বেশি, সেই
দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি অগ্রসর।
গুণগত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের নানাবিধ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অন্তর্নিহিত গুণ উন্মোচনে
সহায়তা করে। এটি একদিকে শিশুদের কুসংস্কার থেকে বিজ্ঞানমনস্ক ও সংস্কৃতিমনা হিসেবে গড়ে
উঠতে উৎসাহিত করে, অন্যদিকে এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, আর শিক্ষার্থীদের
সঠিক দক্ষতা ও প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনের মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের দিকে ধাবিত করে।
শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, জীবন দক্ষতার উন্নয়ন, দৃষ্টিভঙ্গির গুণগত পরিবর্তন এবং
সামাজিকভাবে সচেতন করে তোলাসহ পরবর্তী ধাপের শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে তোলা একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা অর্জনই প্রকৃত অর্থে গুণগত শিক্ষা। দেশের অর্থনৈতিক ও
সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে বাস্তবমুখী ও প্রয়োগমুখী করে তুলতে হবে। আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি দিচ্ছে, পরবর্তীকালে বাস্তব জীবনে তা কতটুকু
কাজে লাগাতে পারছে, তা ভাবার দরকার রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহারিক
ও কর্মমুখী শিক্ষার পরিবর্তে পুঁথিগত বা তাত্ত্বিক শিক্ষায় বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা
নেওয়ার পর তরুণদের মধ্যে যে উচ্চ আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে, তা যখন তারা পূরণ করতে পারছে না,
তখন তাদের মধ্যে একটি হতাশার জন্ম দিচ্ছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি শ্রমের প্রতি
শ্রদ্ধাশীল দক্ষ জনবল তৈরি করতে সক্ষম হতো তবে আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই
আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারতাম। তবে সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষায়
লেখাপড়া করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কৃষিকাজ, পশুপালন, মৃৎশিল্প, তাঁতশিল্প, মৎস্যশিল্প ইত্যাদি
যে ছোটো কাজ নয় তা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই আমাদের সন্তানদের শেখাতে হবে। জাপানি একটি
প্রবাদ রয়েছে, ‘তুমি আমাকে একটি মাছ দিলে মানে তুমি আমাকে একবেলা মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা করে
দিলে। কিন্তু তুমি আমাকে মাছ ধরার কৌশল শেখালে মানে তুমি আমাকে সারাজীবন মাছ খাওয়ার
ব্যবস্থা করে দিলে।’
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে গেলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত। অভাব শুধু গুণগত বা মানসম্মত শিক্ষার। শিক্ষারমান বাড়বে
শিক্ষকদের গুণে। শিক্ষার মান উন্নত করতে শিক্ষকের ভূমিকাই সর্বাধিক অগ্রগণ্য। অভিভাবকদের
সচেতন করার দায়িত্বও শিক্ষকদের। শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষককে আন্তরিক হতে
হবে। দরদি মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত আধুনিক সফল, যথাযথ ও নিয়মিত
পাঠদান এবং শিক্ষাদান শিক্ষার্থীদের জন্য বড়ো প্রাপ্তি আর শিক্ষকদের বড় সন্তুষ্টি, সাফল্য
গাঁথা কৃতিত্ব
শিক্ষকতা হচ্ছে অন্যান্য পেশার রোল মডেল। একজন শিক্ষক, সমাজ ও জাতি গড়ার কারিগর
ও বিবেক। এজন্য গুণগত শিক্ষা অর্জনের জন্য চাই একদল যোগ্য ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক। একজন
শিক্ষকের জীবনাদর্শ হবে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য আলোকবর্তিকাস্বরূপ। শিক্ষক তাড়িত হতে
হবে বিবেক দ্বারা। শিক্ষার্থীদের আত্মোপলব্ধির প্রয়োজনে চমৎকার উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকবে
শিক্ষকদের।
গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষাই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সুশিক্ষাই শারীরিক সুস্থতা ও
উদ্ভাবনী শক্তিকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সক্ষম। গুণগত
শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান উপায় হচ্ছে মানসম্মত বা মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ। ভালো শিক্ষাগত
যোগ্যতার অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ করতে হবে।
এজন্য বৈষম্যহীন শিক্ষা, আধুনিক ও আন্তর্জাতিকমানের শিক্ষাক্রম, মানসম্মত ও পেশার
প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ শিক্ষক, প্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় এনে ধরে রাখা,
সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি নির্মূল ও অপচয়রোধ রোধ করতে হবে । আমাদের দেশের
শিক্ষার নিচুস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে
হতে হবে। স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ চিরতরে বন্ধ করতে হবে। মেধা ও যোগ্যতাকে
পাশকাটিয়ে শিক্ষক নিয়োগ এর কারণে অনেক মেধাবী এক বুক কষ্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায় এবং
এটা গুণগত শিক্ষার জন্য বিরাট বাধা।
প্রাইভেট পড়া হোক আর কোচিং করা হোক সুষ্ঠু পাঠদানের জন্য শ্রেণিকক্ষই যথেষ্ট।
অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষই হবে সব। শুধু শিক্ষকদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও ইচ্ছাশক্তির নিশ্চিত করা
দরকার। তাই কোচিং সেন্টার নয়, শ্রেণি কক্ষই হোক শিক্ষাদানের প্রাণকেন্দ্র। এখন বাস্তবায়নের
প্রয়োজন। প্রাইভেট ও কোচিংয়ের নামে শিক্ষা বাণিজ্যকে সম্যকভাবে নিরুৎসাহিত করার জন্য
অভিভাবক ও সুধী সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। কোচিং ও প্রাইভেটের নামে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার
মান।
একজন শিক্ষক হচ্ছে সমাজ ও জাতি গড়ার কারিগড়। তাই একজন শিক্ষক তার সর্বোচ্ছ দিয়ে
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান দেয়। তাদের ভাবনায় জাগ্রত করতে হবে নতুন নতুন গবেষণা নতুন নতুন
আবিষ্কার। তাদের চেতনায় থাকতে হবে সৃষ্টিশীল উদ্ভাবন। তাদের আকাঙ্কায় থাকতে হবে
শিল্পবিপ্লবের এই যুগে বিশ্বের সাথে মিলিয়ে চলার পথ তৈরি করা।
#
লেখক: সিরাজ উদ-দৌলা খান,সিনিয়র তথ্য অফিসার (পিআরও) শিক্ষা মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার