বুক রিভিউ: ন্যায়বিচারের অন্বেষণে

এক বসাতেই পড়ে ফেললাম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলামের লেখা সুপাঠ্য বই “ন্যায়বিচারের অন্বেষণে”। লেখক পেশায় একজন বিচারক। তিনি এমন একজন বিচারক, যিনি বিচার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি অপরাধ বা অপরাধীদের নিয়েও যে গভীরভাবে ভাবেন এবং সেটি তাঁর বিভিন্ন কাজে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়। লেখকের প্রবন্ধগুলোর দাবী অনেক সংক্ষিপ্ত, সূক্ষ্ম, গভীর, ইশারাধর্মী ও মানবিক।

“ন্যায়বিচারের অন্বেষণে” বইটি লেখকের ধারাবাহিক চিন্তাশীল কাজের একটি উজ্জ্বল প্রতিফলন। এটি নির্দিষ্ট কোনো আইনের বই নয়; তবে সামগ্রিক বিচার প্রক্রিয়া, সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং জেলের বন্দীদের সামষ্টিক পুনর্বাসন তথা কল্যাণ নিয়ে লেখক তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সমাজের মূলধারায় কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়, সে বিষয়ে সুচিন্তিত মতামতও তুলে ধরা হয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়ায় ছোটখাটো কিছু ত্রুটি যা অনেক সময় বিজ্ঞ বিচারক, বিজ্ঞ আইনজীবী কিংবা সংশ্লিষ্ট পুলিশের চোখ এড়িয়ে যায়, সে ধরনের কিছু বিষয় লেখক অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন এবং সেখান থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দিয়েছেন। যেমন, একজন ব্যক্তিকে পুলিশ যখন কোনো পরোয়ানামূলে এরেস্ট করে, তখন তার একটি এরেস্ট মেমো প্রস্তুত করার বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে এই বইতে তুলে ধরা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ   নগরীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার ১৪ জন

আমি ২০০৮ সালে যখন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম পঞ্চগড়ে, তখন এই মেমোরেন্ডাম অব এরেস্ট বিষয়টির প্রচলন ছিল না। ফলে প্রায়ই দেখা যেত শুধুমাত্র নামের মিলের কারণে একজনের পরিবর্তে অন্য একজন ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। কিন্তু এই এরেস্ট মেমোর কারণে এই বিভ্রান্তি একেবারেই দূর হয়ে গেছে। এটি বিভিন্ন জেলাতে পর্যায়ক্রমে চালু করা হয়েছে। এতে অনেক নিরপরাধ মানুষ হয়রানির হাত থেকে বাঁচবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

আবার ধরা যাক, কোনো একজন ব্যক্তি অসৎ লোকের সঙ্গ পেয়ে অনেক সময় ছোটোখাটো একটা অপরাধ করে ফেললেন। আদালত তাকে সাজা দিলেন ১ বছর কারাদণ্ড। কিন্তু এই ব্যক্তির অতীত রেকর্ড খুব ভালো। ইতোপূর্বে তার কোনো খারাপ কাজের বা আইন অমান্যের কোনো নজির নেই। এ ধরনের দণ্ডিত ব্যক্তিকে জেলখানায় না পাঠিয়ে বিজ্ঞ বিচারক কিছু শর্তসাপেক্ষে মুক্তি বা অব্যাহতি দিতে পারেন; যদি তিনি দ্বিতীয়বার আর কোনো অপরাধ না করেন, আইন কানুন মেনে চলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজ না করেন। এরূপ ক্ষেত্রে আদালত তাকে জেলে না দিয়ে ১ থেকে ৩ বছরের জন্য প্রবেশনে মুক্তি দিতে পারেন। গতানুগতিক শর্তের বাইরেও প্রতিটি মামলার নিরিখে বই পড়া, গাছ লাগানো এবং প্রবীণদের সেবা করার মতো বিভিন্ন শর্তও তাকে দেওয়া যায়। এই শর্তগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঠিকঠাক মতো মেনে চললে তাকে জেলে না পাঠিয়েও মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেওয়া যায়। এতে করে সে জেল জীবনের কলঙ্ক (stigma of Jail life) থেকে বাঁচার পাশাপাশি একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সমাজে পুনর্বাসিত হবে।

আরও পড়ুনঃ   বিচ্ছেদ গুঞ্জনের মাঝে নীলাঞ্জনার ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট

এরকম বিষয়গুলো এই বইতে খুব সহজ এবং সাবলীলভাবে গল্পাকারে তুলে ধরা হয়েছে। বইটি যদিও আইন ও বিচার অঙ্গনের মানুষদের জন্য লেখা, তথাপি এর সহজ এবং সাবলীল ভাষার কারণে সব শ্রেণির পাঠকের কাছে সহজবোধ্য মনে হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখকের আইনাঙ্গনে ব্যাপক সমাদৃত “প্রবেশন ও প্যারোল আইন – তত্ত্ব ও প্রয়োগ” বইটিও আমি পড়েছি। উভয় বইয়ের মূল কথা হলো, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অপরাধের কারণ নির্ণয় পূর্বক অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা এবং কিছু পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় কারাবাস রোধ করা।

বইটি প্রকাশ করেছে লেক্সিলেন্স প্রকাশনী এবং প্রচ্ছদ মূল্য ৪০০ টাকা মাত্র।

লেখক – মো. আব্দুল মালেক, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ, রাজশাহী।