‘গান শুধু বাণিজ্যিক বিষয় নয়, সংস্কৃতিকেও ধারণ করে’

অনলাইন ডেস্ক : আলম আরা মিনু রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, নাটক ও মঞ্চে নব্বই দশক থেকেই গানের ভুবনে নক্ষত্র হয়ে জ্বলছেন। অজস্র গানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন নিজের গায়কীর উচ্চতা। প্রায় ২০টি একক অ্যালবাম, শতাধিক মিক্সড অ্যালবাম এবং প্রায় ১০০টি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।

সংগীতে তার জার্নি ও বর্তমান সময়ের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন শিশির রোয়েদাদ

সংগীতের যাত্রা ও প্রথম অ্যালবাম সম্পর্কে জানতে চাই।

তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। রেডিও শুনে শুনে গান করতাম। বাবা তার স্বপ্নটাকে আমার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন। মা-বাবার পৃষ্ঠপোষকতার জন্যই আমি আজকের আলম আরা মিনু। আমার গানের হাতেখড়ি ওস্তাদ রাখাল নন্দী বাবুর কাছে, পরে গুরুজী সনজিব দের কাছে। তাদের কাছে ক্ল্যাসিকেল, নজরুল, রবীন্দ্র ও অন্যান্য গানের তালিম নিয়েছি। আধুনিক গান আর গজাল নিজ আগ্রহে শুনে শুনে শিখেছি।

গান নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

পারিপার্শ্বিক চাপে ও সময়ের বাস্তবতায় অনেক স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সে অনেক কথা। তবে গানের মানুষ হিসেবে আমার স্বপ্ন গানের সাথে থাকা মানুষগুলোর চলার পথ সহজ করার জন্য কাজ করে যাওয়া।

কখন বুঝলেন মানুষের প্রিয় শিল্পী হয়ে উঠেছেন?

১৯৯০ সালে বিটিভির নাটকের জন্য ‘যে বাতাসে ফোটে ফুল’ শিরোনামের একটি গান করেছিলাম। নাটকটি প্রচার হওয়ার পর সারা দেশের মানুষ গানটির অ্যালবাম খুঁজেছেন। এত চিঠি ও ভালোবাসা পেয়েছি যে, তখন বুঝতে পেরেছি আমার একটি ভক্তকুল তৈরি হয়েছে।

আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কী বলবেন?

আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সমৃদ্ধ সময় আমরা পেয়েছি। নব্বই দশকের কথা, অনেক অ্যালবাম হতো। বেশ কিছু সফল অডিও কোম্পানি ছিল। নাটক, সিনেমায় সংগীতশিল্পীদের বেশ মূল্যায়ন ছিল। গান গেয়ে টাকাও পাওয়া যেত। চোখের সামনে সেই ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে গেল। শিল্পীরা এখন নিজ টাকা খরচ করে গান করে অনেকেই, আর কিছু শিল্পী স্টেজে পারফর্ম করে টিকে আছে। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির কথা বলতে গেলে খারাপ লাগে। পাইরেসি শুরু হওয়া থেকেই ইন্ডাস্ট্রির বেহাল দশার শুরু। রয়‍্যালিটির সিস্টেমটা চালু হওয়া উচিত। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিল্পী সমাজ নিয়ে ভাবার চর্চা নেই। ব্যক্তিগত ভাবনায় বেঁচে থাকে শিল্পী। এই জন্যই ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়ায়নি। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির জন্য আমাদের শিল্পীদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরও পড়ুনঃ   আমার কোনো ছেলে বন্ধু ছিল না : শিরিন শিলা

কনসার্টের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই।

কনসার্টে গান করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। প্রায় ৫০টি দেশের স্টেজের স্মৃতি আছে। কনসার্টে গাওয়ার সময় যে অনুভূতি কাজ করে সেটা বলে বোঝানো যায় না। অনেকের আনন্দ-খুশির অনুভূতি নিজের পারফরম্যান্সের মধ্যে ঢুকে যায়। যা রেকর্ডিং ভার্সনে সম্ভব না। স্টেজ শিল্পীর জন্য অসাধারণ অনুভূতির একটি জায়গা।

ব্যান্ড করেছেন কখনো?

যখন আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের সাথে প্রথম অ্যালবামের কাজ করি, তখনই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ব্যান্ড করার। এখনো ইচ্ছে আছে। আমার মেয়ে ব্যান্ডের গান খুব পছন্দ করে। ওদের নিয়েও ব্যান্ড করে ফেলতে পারি।

কোন গানকে আদর্শ গান বলবেন?

কথা, সুর, মিউজিক সাথে ইমোশন, ইনফরমেশন এবং মোরালিটি যে গানে থাকবে সেটাকেই আমি আদর্শ গান বলব। বর্তমানে কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
গান গাওয়া, লেখা ও সুর করার কাজে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। কিছু নতুন রকমের কম্পোজিশন করার চেষ্টা করছি। নতুনদের সাথে কাজ করার কিছু পরিকল্পনা রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ   ‘আমি ক্যানসার আক্রান্ত, সেটা ছেলেকে বলা সবচেয়ে কঠিন ছিল’

আপনার পছন্দের একটি গানের পেছনের গল্প সম্পর্কে জানতে চাই।

‘বেদনার বালু চরে’ অ্যালবামে একটি গানে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য স্টুডিওতে গিয়েছি। অ্যালবামটির সুরকার ছিলেন প্রণব ঘোষ, গীতিকার আহমেদ রিজভী। এই অ্যালবামে ‘রাজ প্রাসাদের সুখ’ শিরোনামে একটি গান গাইছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত জুয়েল ভাই। রেকর্ডিং চলছে সেই মুহূর্তে একজন বললেন, গানটি তো মেয়ে কণ্ঠের গান। গানের কথা তাই বলে। প্রণব কাকা একটু চুপ থেকে বললেন, জুয়েল তুমি বের হও। মিনু যা গানটা গেয়ে দে। জুয়েল ভাই আমার খুব পছন্দের শিল্পী, প্রিয় মানুষ। আমি সংকোচবোধ করছিলাম। কিন্তু প্রণব কাকার ধমকে ঢুকে পড়লাম ভয়েস রুমে। গানটি গাইলাম। রেকর্ডিং শেষে প্রণব কাকা আমাকে ৫০০ টাকার একটি নোটে লিখে দিলেন ‘যা গাইছিস তার রেজাল্ট খুব দ্রুত পাবি।’ কিছুদিন পরই গানটি খুব জনপ্রিয় হয়, এখনো গানটি সমান জনপ্রিয়।

দেশের শিল্পীদের পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?

আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি, তা সবার জানা। একটি সমাজে শিল্পীদের ভূমিকা আছে। শিল্পীরা কিন্তু কারো ক্ষতি করে না। তারা নিজের মতো করে বাঁচে। শিল্পীদের নিয়ে দেশ এবং সমাজের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকার দরকার আছে। যারা শিল্পী এবং যারা শিল্প ভালোবাসে তারা সবাই এক হয়ে শিল্পীদের জীবনযাপন যাতে সহজ হয় সে চেষ্টা করা উচিত। রাজনৈতিক বা দলীয় কোনো মতাদর্শ থেকে শিল্পীদের দমিয়ে রাখা বা পর করে দেওয়া উচিৎ না। গান শুধু বাণিজ্যিক বিষয় নয়, সংস্কৃতিকেও ধারণ করে।-ইত্তেফাক