২০০৩ সালে মুলতান টেস্টের কথা আমাদের আজও মনে পড়ে। সেই টেস্টে জয়ের খুব কাছাকাছি গিয়াও পরাজিত হয় বাংলাদেশ দল। টাইগারদের হৃদয় ভাঙিয়া পাকিস্তানকে বলিতে গেলে একাই বিজয় আনিয়া দিয়াছিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান ইনজামাম উল হক। শেষ ইউকেট জুটিতে তিনি যেইভাবে ঠান্ডা মাথায় সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করিয়াছিলেন বীরোচিতভাবে, তাহা ছিল সকল ক্রিকেটারের জন্য শিক্ষণীয়। সেই ম্যাচে পরাজয়ের গ্লানি আমাদের এখনো তাড়া করিয়া ফিরে। তবে সুদীর্ঘ দুই দশকেরও অধিক সময় পর অবশেষে আমাদের সেই আফসোস এবং না পাওয়ার বেদনার অবসান হইল। এই বার রাওয়ালপিন্ডি প্রকম্পিত হইল টাইগারদের গর্জনে! পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে ঐতিহাসিক অবিস্মরণীয় বিজয় ছিনাইয়া আনিল টিম টাইগার্স। বিদেশের মাটিতে এই অভূতপূর্ব টেস্ট বিজয়ের জন্য বাংলাদেশের লড়াকু ক্রিকেট দল ও বিসিবি কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সাম্প্রতিক সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রত্যাশানুযায়ী ভালো পারফরম করিতে না পারিবার আক্ষেপ ছিল বাংলাদেশ দলের। ইহা লইয়া ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে কম কথা হয় নাই! উপরন্তু, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ দেশে উদ্ভূত বন্যার পরিস্থিতির রেশ আছড়াইয়া পড়িতেছিল পাকিস্তান সফররত টিম টাইগার্সের উপর। এমন পরিস্থিতিতে ‘একটি বিজয়’ ছিল বহু কাঙ্ক্ষিত। অবশেষে সেই বিজয়ের দেখা পাইলাম আমরা। এই আনন্দের উপলক্ষ্য তৈরির জন্য ধন্যবাদ সংশ্লিষ্ট সকলকে। পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম বারের মতো মর্যাদাপূর্ণ টেস্ট জয়ে আমরা গর্বিত। সফরের পূর্বে যেই দলটি ছিল একেবারে আলোচনার বাহিরে, পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের পূর্ণ শক্তির দলকে অনেকটা হাসিয়া-খেলিয়া তাহারা হারাইয়া দিয়াছে। ‘আপনি পড়িয়া গিয়াছেন কি না, তাহা গুরুত্বপূর্ণ নহে, বরং আপনি উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন কি না, তাহাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ’-এই ঐতিহাসিক বিজয় ক্রীড়া অঙ্গনের উজ্জ্বল তারকা ভিন্স লোম্বার্ডির এই উক্তিকেই আজ স্মরণ করাইয়া দেয়।
বিজয়ের এই মুহূর্তে ক্রীড়া তারকা বিলি জিন কিংয়ের একটি উক্তিও বিশেষভাবে স্মর্তব্য। তাহার মতে, ‘চ্যাম্পিয়নরা ততক্ষণ পর্যন্ত খেলিতে থাকেন, যতক্ষণ না তাহারা জয়ের রাস্তা খুঁজিয়া পান।’ এই টেস্টের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যায়, কোনো বিশেষ নৈপুণ্যে নহে, বরং সম্পূর্ণ দলগত পারফরম্যান্সের উপর ভর করিয়াই আসিয়াছে এই সাফল্য। নিজেদের প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানেরা যখন ৪৪৮ রানের বিশাল স্কোর গড়িয়া তুলে, তখন কি কেহ ভাবিয়াছিলেন যে, ব্যাট হাতে রানের পাহাড় গড়িয়া তুলিয়া পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের মনে কাঁপুনি ধরাইয়া দিবেন মুশফিক-সাদমান-মিরাজ-মমিনুলরা? ইহার পরও আশঙ্কা ছিল! পাকিস্তান দল ঘুরিয়া দাঁড়াইবে-এমন কথা বলিতেছিলেনও কেহ কেহ। তবে শরিফুল-হাসান-সাকিব-মিরাজের বোলিং দাপটে মাত্র ১৪৬ রানেই গুটাইয়া যায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংস। এমন অবস্থায় জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩০ রান, যাহা বিনা উইকেটে টপকাইয়া যান দুই ওপেনিং ব্যাটসম্যান। কেবল বোলিং-ব্যাটিং নহে, এই ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ফিল্ডিংও গভীর দাগ কাটিয়াছে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে। সকল কিছু মিলাইয়া পুরা দলের ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ ছিল অসাধারণ। এইভাবে দলের সকলে যখন নিজের সেরাটা উজাড় করিয়া দেন, তখন জয় অধরা থাকিতে পারে না কোনোভাবেই।
রেকর্ড বুক বলিতেছে, বিদেশের মাটিতে ইহা বাংলাদেশের সপ্তম বিজয়। অধিকন্তু, এই প্রথম বার ১০ উইকেটে জয়ের স্বাদ পাইল বাংলাদেশ-ইহাও এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। অর্থাৎ, এই জয় বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে ‘এক অনন্য কীর্তি’। এই টেস্ট আমাদের জন্য এক মহাকাব্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। আগামী দিনগুলিতে এই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখিয়া টিম টাইগার্স উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করিবে বলিয়া আমরা প্রত্যাশা করি।