মোঃ আরিফ হোসাঈন : উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর- এই ভৌগোলিক অবস্থান ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ুর বাংলাদেশে কৃষিজমিকে নদীবাহিত পলিতে করেছে উর্বর। বর্তমান কৃষি-বান্ধব সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ২৮ লক্ষ ৯৬ হাজার টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৪ কোটি ৭৭ লক্ষ ৬৮ হাজার টন হয়েছে। বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে বিশে^ ৯৪তম দেশ হলেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য মতে ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশে^ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছি আমরা। তবে বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থায় এখনও কিছু সমস্যা রয়েছে, যেমন- উত্তরাধিকারসূত্রে ভূমির মালিকানায় বড় কৃষিজমিগুলো খন্ড খন্ড হয়ে যাচ্ছে, প্রবাসী ভূমি মালিকদের চাষাবাদে অনীহায় তাদের কৃষিজমিগুলো পতিত হয়ে থাকছে, প্রান্তিক কৃষকেরা মূলধন স্বল্পতার কারণে তাদের কৃষিজমিগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে পড়ছেন ও মধ্যস¦ত¦ভোগীদের দৌরাত্মে ফসলের ন্যায্য বাজারমূল্য পাচ্ছেন না। উর্বর কৃষিজমি ও কৃষিকাজে সহায়ক ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও সনাতনী খোরপোশের কৃষি ব্যবস্থায় থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। এসব সমস্যার সমাধানে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ব্যাক্তিমালিকানাধীন একক চাষের পরিবর্তে সমবায়ভিত্তিক বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর।
আবহমানকাল থেকে এদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদানই ছিল সিংহভাগ। বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৫.৩৩ শতাংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত এবং ২০২২-২৩ অর্থ-বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে এ খাতের অবদান ১১.২% (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩)। জনবহুল এদেশে অনেক অনাবাদী জমি যেমন চাষাবাদের আওতায় এসেছে তেমনি কিছু আবাদযোগ্য জমিও পতিত হয়ে পড়ে রয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৮০.০২ লক্ষ হেক্টর ও পতিত জমির পরিমাণ ছিল ৩.৬৭ লক্ষ হেক্টর, সেখানে বর্তমানে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৮.২৯ লক্ষ হেক্টর ও পতিত জমির পরিমাণ ৪.৩১ লক্ষ হেক্টর (কৃষি বর্ষগ্রন্থ-২০১৮, ২০২২)। এ অবস্থায় আবাদযোগ্য জমির উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি পতিত জমিগুলোকেও চাষের আওতায় আনার জন্য সমবায় কৃষি হতে পারে উত্তম সমাধান।
শহর ও গ্রামের মধ্যে জীবনযাত্রার মানের ব্যবধান কমাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বহুমুখী গ্রাম সমবায় সমিতি গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আবাদযোগ্য কৃষি জমির সংকোচন, শিল্পায়নের ফলে কৃষিকাজের জন্য শ্রমিকের অপ্রতুলতা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ এবং সর্বোপরি বিদ্যমান পতিত কৃষিজমি উৎপাদনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা আগেই উপলব্ধি করে তিনি এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সমবায় মালিকানা ও ১৬ অনুচ্ছেদে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ ঘটানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর ব্যব¯থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৃষি উন্নয়নে ও খাদ্যে স¦য়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে কৃষিতে সমবায় পদ্ধতি চালুর তাগিদ দিয়েছেন। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮- এ ভূমির মালিকানা অক্ষুন্ন রেখে সমবায় কৃষি উৎপাদন ও কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকল্পে সমবায়ভিত্তিক বিপণনকে সহযোগিতা ও উৎসাহ প্রদান করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কৃষি সমবায় তিন ধরণের- কৃষি উৎপাদন সমবায় সমিতি, কৃষি সেবামূলক সমবায় সমিতি ও কৃষি বিপণন সমবায় সমিতি। সমবায় কৃষি ব্যবস্থায় ভূমির মালিকানা অক্ষুণ্ন রেখে জমির মালিকেরা সে¦চ্ছায় যৌথ উদ্যোগে তাদের জমিগুলো একত্রিত করে সমবায় সমিতির অধীনে চাষাবাদ করেন। এক্ষেত্রে জমির মালিকেরা তাদের নিজ নিজ জমির পরিমানের অনুপাতে সমবায় সমিতির শেয়ার হোল্ডার হন। সমবায় সমিতির নিয়মিত বেতনভোগী ব্যবস্থাপক বছরের শুরুতেই ঐ ফার্মের অধীন জমিগুলোতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিযন্ত্র, বীজ, সার ও শ্রমিকের সংখ্যাসহ মোট উৎপাদন ও পরিচালন ব্যয় নির্ধারণ এবং সমিতির সভায় তা তুলে ধরেন। অংশীজনদের সম্মতিক্রমে শেয়ার হোল্ডারদের চাঁদা ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যাংক বা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়। মৌসুম শেষে উৎপন্ন ফসল সমবায় সমিতির দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাজারজাতকরণ করা হয় এবং শেয়ার হোল্ডার বা জমির মালিকেরা জমি অনুপাতে তাদের লভ্যাংশ পেয়ে থাকেন। এ ব্যবস্থায় চাষাবাদের ইতিবাচক দিকগুলো হচ্ছে –
১) আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ছোট খন্ড খন্ড জমির সীমানা বা মাটির আইল তুলে দিয়ে বৃহদায়তন চাষ পদ্ধতি প্রর্বতন করা যায়। এতে একদিকে যেমন অনায়াসে ট্রাক্টর দ্বারা জমি কর্ষণ করা যায়, অন্যদিকে উন্নত বীজ রোপন, সার-কীটনাশক ছিটানো ও ফসল সংগ্রহের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রম, সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয় এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২) প্রবাসী ও অন্যান্য ভূমি মালিকগণ যারা জনবল সংকটের কারণে পর্যাপ্ত জমি থাকা সত্ত্বেও চাষাবাদ করতে পারছেন না তাদের জমিও চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে অনাবাদী পতিত জমির পরিমাণ কমে আসে।
৩) সমবায় বিপণন ব্যবস্থায় কৃষকরা সরাসরি ভোক্তাদের কাছে তাদের ফসল বিক্রি করে ন্যায্য বাজারমূল্য পায়। ফলে বাজার সরবরাহ ব্যব¯থায় মধ্যস¦ত¦ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে।
৪) সমন্বিত ও কার্যকর পানি ব্যব¯থাপনার মাধ্যমে সব জমিতে সময়মতো সেচ দেওয়া যায় এবং এর ফলে ফসল উৎপাদন ব্যয় কমে।
৫) কৃষকদের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে।
৬) ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকেরা সমবায় সমিতির অধীন জমিগুলোতে কাজ করে ন্যায্য মজুরি পান। ফলে সমবায় কৃষি আয়-বৈষম্য হ্রাস করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
কৃষি ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নতদেশ যেমন ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, জাপান প্রভৃতির ন্যায় এদেশেও সমবায়ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন (Coperative agricultural farming and marketing) ব্যবস্থার প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। ডেনমার্কে প্রায় ৯০ শতাংশ দুগ্ধ উৎপাদন খামারগুলো সমবায় ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে বহুল পরিচিত সমবায় দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আমুল ১৯৪৬ সাল থেকে ১৩ হাজার গ্রামে বিস্তৃত প্রায় ৩৬ লক্ষ সদস্যের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সমবায় কৃষির মাধ্যমে একসময়ের আমদানি নির্ভর দেশ ভিয়েতনাম বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় চাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। ভিয়েতনামে প্রায় ৩১ হাজার সমবায় কৃষি সমিতি ওয়ান কমিউন ওয়ান প্রোডাক্ট প্রকল্পের মোট উৎপাদনে ৪০% অবদান রাখছে। বাংলাদেশে যদিও রাতারাতি এ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়, তবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ভিয়েতনামের মত পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এর উপযোগিতা যাচাই করা যেতে পারে। ২০১৮ সালে কুড়িগ্রাম জেলায় ধান উৎপাদনের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সমবায় কৃষিতে ব্যক্তিগত একক চাষের তুলনায় প্রায় ১২.৬% ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সারাদেশে ব্যাপক আকারে সমবায় কৃষি চালু করা হলে অমিত সম্ভাবনার উর্বর বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে আমরা আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে পারবো। লেখক-তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী
—-পিআইডি ফিচার