স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের দুই পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বানেশ্বর আমের রাজ্য। কালের বিবর্তনে গরুর এ হাটটি পরিণত হয়েছে আমের হাটে। জমজমাট হাটে পাকা আমের মিষ্টি গন্ধে ম-ম করে চারদিক। কাছারি মাঠে গরমে একটু স্বস্তি বলতে মাঠের দুই পাশে কড়ইগাছগুলোর ছায়া। গাছগুলোর নিচে একে অপরের গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে শতাধিক আমবোঝাই ভ্যানগাড়ি। পাশে আরেকটি ছোট মাঠ। সেটিও আমের ভ্যানে ভরা। মাঠ পেরিয়ে ওপরে উঠতেই রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক। এর দুই পাশেও রয়েছে গাছের ছায়া। আর ছায়ায় ছায়ায় মহাসড়কের দুই পাশে যত দূর চোখ যায় শুধু আম আর আম। আমবোঝাই কয়েকশ’ ভ্যান নিয়ে অপেক্ষমাণ বিক্রেতা আর পাইকারদের ভিড়ে এক জমজমাট হাট। সারাদেশে এর এক নামে পরিচয় বানেশ্বরের আমের হাট। ব্যবসায়ীদের সুবিদ্ধার্থে শনিবারও সব ব্যাংকের শাখা খোলা রাখা হচ্ছে।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরের আমের হাট। শুধু আমের হাটই নয়, ধান ও সবজি হাট তথা মোকাম হিসেবেও পাইকারদের কাছে এর পরিচিতি রয়েছে। তবে দেশজুড়ে এই হাটের যে সুনাম, সে আমের হাটের জন্য। যার পরিচিত এখন দেশ ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। মূলত এই হাটের যত মহিমা, তা রাজশাহীর সুস্বাদু আমের জন্যই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমের ভরা মৌসুমে প্রতিদিন এই বাজারে অন্তত এক থেকে দেড় কোটি টাকার আমের কেনাবেচা চলে। সেই আম যায় ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রংপুর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আবার দেশের বাইরেও বানেশ্বর বাজারের আমের আলাদা কদর আছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের সবচেয়ে বড় আমের হাট পুঠিয়ার এই বানেশ্বরের আমের হাট। এই হাটে এখন যেসব আম বেচাকেনা চলে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গোপালভোগ, হিমসাগর, লখনা, ল্যাংড়া, দুধস্বর ও গুটি জাতের আম। এসব আমে যেন ভরপুর হয়ে উঠে বানেশ্বর বাজার। আমগুলো আসে জেলার পুঠিয়া, বাঘা, বাগমারা, দুর্গাপুর, পবা ও মোহনপুর উপজেলা থেকে। এর বাইরেও কিছু আম আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর থেকে। তবে বর্তমানে বানেশ্বর বাজারে গুটিআম, গোপালভোগ, রানীপসন্দ, হিমসাগর, ক্ষিরসাপাত ও লক্ষণভোগ আম পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে বানেশ্বর হাট এখন সরগরম। প্রতিদিন হাট বসলেও শুক্রবার জমে সবচেয়ে বেশি। ছুটির দিনে ভিড়ও বেড়ে যায়।
আমের রাজা গোপালভোগ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৪০০, হিমসাগর ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ ও রাণীপসন্দ ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। এছাড়া সাধারণ মানের আম বিক্রি হচ্ছে রকমভেদে মণপ্রতি ৬০০-৭৫০ টাকায়। তবে এখন পর্যন্ত ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি এবং আশ্বিনা জাতের আম বাজারে আসেনি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দেশের অন্যান্য জায়গায় ৪০ কেজিতে মণ ধরা হলেও এখানে ৪৫ কেজিতে ধরা হয়। চারঘাটের বাগান মালিক আমানুল ইসলাম জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আম ব্যবসায়ীরা বানেশ্বর হাটে ভিড় জমান। বেচাকেনা বেশি হওয়ায় অন্য হাটের চেয়ে আমের দামও তূলনামূলক কম। বানেশ্বরের আমের আড়তদার মো: শাজাহান আলী জানান, দালাল ছাড়াই বানেশ্বর হাটে আমের বেচাকেনা হয়। কাজেই এখানে আম কিনে ঠকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ঢাকার আম ব্যবসায়ী আকবার হোসেন জানান, রাজধানী থেকে প্রতি বছরই আম কিনতে রাজশাহীতে আসেন। রাজশাহীর অন্য হাট ও আড়তে না গিয়ে বানেশ্বর থেকে আম কিনলে যাতায়াত খরচ অনেক কম পড়ে। আম ব্যবসায়ী মুনসুর আলী বলেন, বাজারে মূলত আমের কেনাবেচা শুরু হয় দুপুর ১২টার দিকে। এরপর চলে বিকেল সাড়ে ৩টা নাগাদ। আর আম কেনার পর সেগুলো ঝুড়ি করা থেকে শুরু করে ট্রাকে ওঠানো পর্যন্ত। প্রতিদিন তিনিই অন্তত দুই লাখ টাকার আম কেনেন। তাঁর মতো এ বাজারে অন্তত ১৫০ জন পাইকারি ব্যবসায়ী আসে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। ফলে সব ব্যবসায়ী মিলে প্রতিদিন অন্তত এক কোটি টাকার আম কেনাবেচা হচ্ছে এ বাজারে।
রাজশাহী ফল গবেষণাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিকটন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালী জানান, ৮ জুন থেকে ল্যাংড়া, ১০ জুন থেকে ফজলি, ২০ জুন থেকে আম্রপালি এবং ১৫ জুলাই থেকে আশ্বিনা আম নামাতে পারবেন চাষি। রাজশাহীর আম বিদেশেও রফতানি শুরু হয়েছে। তবে ২৬ শর্তে চীন ও ইউরোপে ১০০ মেট্রিক টন আম রফতানি করা হবে। উন্নতমানের আম রফতানি করতে বাগানে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি।