দিলরুবা চৌধুরী : বাংলাদেশ ক্রমাগত বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম চারটি রফতানি, আমদানি, বিনিয়োগ ও সাময়িক অভিবাসন। বিদেশে শ্রমিক প্রয়োজন এবং ক্রমাগত দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ শ্রমিক প্রাায় ১০ গুণ বেশি আয় করেন। আর শ্রমিকের দক্ষতা নির্ভর করে শিক্ষার মানের ওপর। এ জন্য সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা মাথায় রেখেই দক্ষ কর্মজ্ঞান সম্পন্ন লোকবল সৃষ্টি করছে সরকার।সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে সামগ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সবকটি লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে । ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবেও বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত। পরবর্তী লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ।’ উল্লেখ, বিশ্বে বাংলাদেশ এখন অন্যতম ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ, যেখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সফলভাবে সম্ভব হচ্ছে। যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণের ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে সরকারের নেয়া অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ সংক্রান্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ নবজাত শিশু ও মাতৃ-মৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, কর্মসূচি ও অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুঃস্থ, সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও এতিম জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর্থিক খাতে সংস্কার, দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে প্রয়োজন মানস্মত শিক্ষা। দেশের মানুষকে কারিগরি ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে দক্ষ করে তুলা হচ্ছে। যাতে তারা পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে চলতে পারে। দক্ষ জনশক্তি আমাদের দেশের উন্নয়ন খাতে অবদান রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে। এ কারণেই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে উচ্চশিক্ষাকে নতুন করে সাজানোর কথা বলা হচ্ছে । গতানুগতিক চিন্তার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব না। শিক্ষার সকল স্তরে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি ও শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার অনেকগুলো কর্মসূচি বাস্থবায়ন করেছে এবং করছে । প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, উপবৃত্তি ও ছাত্র-শিক্ষক সংযোগ ঘণ্টা বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘রূপকল্প ২০২১’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ হিসেবে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। এই শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হলো মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত যুগোপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন সূচকে সাফল্য অর্জিত হয়েছে এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবার শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, ঝরে পড়া রোধ, শিক্ষাকে মানসম্মত, সর্বব্যাপী ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে। বছরের প্রথম দিন পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস উদযাপন করা হয় । এ দিন সারা দেশে একযোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়।
সরকার টেকসই ও মানসম্মত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারণে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে আসছে। মাধ্যমিক শিক্ষার হার ও জেন্ডার সমতায় অর্জিত সাফল্য ধরে রাখার লক্ষ্যে সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ছাত্র ও শিক্ষকদের বৃত্তি-উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান, মেধার বিকাশে নানারূপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন, সহায়ক নীতিমালা ও পরিবেশ তৈরি, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা প্রদান, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, ই-বুকের প্রচলন, উপজেলা আই.সি.টি. ট্রেনিং ও রিসোর্স সেন্টার স্থাপন অব্যাহত রয়েছে।চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একই সাথে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে বিবেচনায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা কার্যক্রমে আইসিটি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীর মাঝে উপবৃত্তি ও টিউশন ফি মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১ম থেকে আলিম শ্রেণি পর্যন্ত কুরআন, আকাইদ ও ফিকাহ, আরবি ও হাদিস বিষয়ের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়েছে। বিদ্যমান সাধারণ শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত আরবি বিষয়সমূহ ব্যতীত সাধারণ আবশ্যিক এবং ঐচ্ছিক বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসৃত হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের সব উন্নয়ন নীতির মূলে রয়েছে সকলের জন্য ন্যয়সংগত কাজের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়াস। সরকার সাধারণ শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষের পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যক্রমে জীবন ও জীবিকা সংক্রান্ত পাঠ এবং প্রয়োজনীয় জীবন অভিজ্ঞতার পাঠ সন্নিবেশিত হয়েছে। তাছাড়া কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মান উন্নয়নে সরকার বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ধারাবাহিক বিনিয়োগের ফলে স্বাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে ।সাধারণ শিক্ষার ন্যায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এছাড়া স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেয়েদের হার ছেলেদের অংশগ্রহণের হারকেও ছাড়িয়ে গেছে।সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপসমূহের ফলে দক্ষতা উন্নয়নে গুণগত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এছাড়া নারী শিক্ষার প্রসার ও মান বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে এখন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের এক কোটিরও বেশি মানুষ কর্মরত আছে। প্রবাসীদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ডিগ্রিধারীর সংখ্যা খুবই কম। প্রযুক্তির নানা বিকাশ, শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির রাজত্ব গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কাঠামোয় এনেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে বিশ্বব্যাপী কারিগরি জ্ঞানের কদর খুব সহজেই চোখে পড়ে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে ফিউশন অব ফিজিক্যাল, ডিজিটাল এবং বায়োলজিকাল স্ফেয়ার। এখানে ফিজিক্যাল হচ্ছে হিউমেন, বায়োলজিকাল হচ্ছে প্রকৃতি এবং ডিজিটাল হচ্ছে টেকনোলজি। আমাদেরকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে হলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সর মতো বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিগত আলোড়ন সর্বত্র বিরাজমান। এ বিপ্লব চিন্তার জগতে, পণ্য উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে।
টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্যমোচন ও অসমতা হ্রাস করে জনগণের জীবনমানে গুণগত পরিবর্তন সরকারের প্রধান লক্ষ্য। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা আবশ্যক। বিবিএস পরিচালিত শ্রমশক্তি জরিপ, ২০২৩ অনুযায়ী ১৫ বছর বয়সের উর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৭.৩৫ কোটি। বিপুল কর্মক্ষম এই জনসম্পদকে কাজে লাগিয়ে জনভিত্তিক লভ্যাংশ আহরণে সরকার নানা উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির দ্বারা সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নের নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে এর সুফল পাওয়া যাবে।
#
পিআইডি ফিচার