৪০ বছর পর দেশে ফিরে গেল নেপালী নাগরিক

বগুড়া প্রতিনিধি : বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত বাংলাবান্ধার কাছেই নেপালের হিলাম জেলা। সেই জেলায় গোরখা বাগিনা বাজার নামক এলাকায় তার বাড়ি। সংসারে খুব একটা স্বচ্ছলতা ছিল না। তাইতো ১২-১৫ বছর বয়সেই জীবন জীবিকার তাগিদে কাজ করতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সত্তর দশকের শেষ দিকে কাজের সন্ধানে পথভ্রষ্ট হয়ে চলে আসলেও আর ফিরতে পারেনি ১৫ বছর বয়সী টগবগে যুবক। এদেশেই আটকে পরে ঠিকানাবিহীন ঘোরাফেরার এক পর্যায়ে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদরের একটি চাতালে আশ্রয় নেয় বীর-কা বাহাদুর রায়।

আর তখন থেকেই দীর্ঘ এই সময় কখনও চাতাল শ্রমিক, কখনও হোটেল শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। এরপর উপজেলা সদরের অলক ও বাবলুর যৌথ মালিকানাধীন চাতালে বীর-কা-বাহাদুর কাজ নেন। পরিশ্রমী ও বিশ্বাসী বীর-কা-বাহাদুর তার কাজের মাধ্যমে চাতাল মালিকের বিশ্বস্ততা অর্জনের পাশাপাশি মালিকের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। চাতাল ব্যবসা বন্ধ হলেও বীর-কা-বাহাদুর তার আশ্রয়দাতা অলকের চাতালের পাশে একটি ঘরে বসবাস করতে থাকেন।

নিজের আত্মীয় স্বজন না থাকায় বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি তার, ভাগ্যে মেলেনি পিতা বা বাবা ডাক শোনার। তাইতো তার জীবনে নিঃসঙ্গতাই স্মৃতিপটের অ্যালবামে লিপিবদ্ধ থাকলো। আর এভাবেই হয়তো একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে চিরকুমার বীর-কা বাহাদুর রায়ের। এমনই দৃশ্য তার চোখে-মুখের ভাষায় পরিলক্ষিত হচ্ছিল।

বয়স বাড়ার কারণে কাজ আর ঠিক মতো করতে পারেন না প্রায় ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বীর কা বাহাদুর। তাই অন্যের করুণায় দিন কাটাতে হচ্ছিলা। এমন খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দুপচাঁচিয়া উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী অফিসার সুমন জিহাদী নেপালি নাগরিক বীর-কা-বাহাদুরকে তার অফিসে ডেকে নেয়। বিস্তারিত শুনে নেপালী দুতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করার একপর্যায়ের বীর বাহাদুর রায়ের পরিবারের সাথে ভিডিওকলে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে তারাও নেপালি নাগরিক বীর-কা-বাহাদুরকে দেশে নিয়ে যাওয়ার সম্মতি জানান। এরপর শুরু হয় অফিসিয়াল কাজকর্ম ও কাগজপত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন উপজেলা প্রশাসন। এমনটাই দাবী করেন, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(বর্তমানে শেরপুর উপজেলা কর্মরত) মো. সুমন জিহাদী।

আরও পড়ুনঃ   গুরুদাসপুরে একরাতে ৩৬ মিটার চুরি

এরই ফলশ্রুতিতে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) নেপাল দূতাবাসের উদ্যোগে বাংলাবান্ধা সীমান্ত হয়ে নিজ দেশে ফিরে যান বীর কা বাহাদুর রায়।

দীর্ঘদিন অবস্থান বীর কা বাহাদুর যখন করা দুপচাঁচিয়ায় এলাকা ছাড়েন তখন এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একদিকে তাঁকে বিদায় দেওয়ার বেদনা, অন্যদিকে স্বজনদের কাছে তিনি ফিরতে পারছেন সেই আনন্দের মিশ্রন দেখা দেয় এলাকাবাসীর মধ্যে। এদিকে দীর্ঘদিন পর নিজ দেশে ফিরতে গিয়ে নিজেরও মন খারাপ বীর কা বাহাদুরের। তিনি আবার ফিরে আসবেন বলে জানান স্থানীয়দেরকে।

গত বুধবার সন্ধ্যায় বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় গিয়ে বীর কা বাহাদুরকে দেশে ফেরানোর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন নেপাল দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি উজানা বামজান। এসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন ললিতা শিলওয়াল ও একই দূতাবাসের অ্যাম্বাসেডর সেক্রেটারি রিয়া ছৈত্রী। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ছিলেন দুপচাঁচিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাত আরা তিথি ও দুপচাঁচিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) সনাতন চন্দ্র সরকার। বৃহস্পতিবার( ২৩ মে) সকাল ৯ টার দিকে বগুড়া সার্কিট হাউস থেকে বীর কা বাহাদুরকে নিয়ে দুতাবাস কর্মকর্তারা বাংলাবান্ধা সীমান্তের উদ্দেশে রওনা করেন।

দুপচাঁচিয়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষে নেপাল দূতাবাসের অ্যাম্বাসিডরের সেক্রেটারি রিয়া ছৈত্রী জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বীর কা বাহাদুরের আটকে পড়ার খবর নজরে এলে উপজেলা প্রশাসন থেকে দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়। ওই খবরে যে এলাকার কথা বলা হচ্ছিলো তা পূর্ণাঙ্গ ছিলো না। তারপরও নেপাল সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেন। ওই জায়গার নামের সঙ্গে মিল খুঁজে বের করা হয় বীর কা বাহাদুরের নিজ জন্মস্থান। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত বাংলাবান্ধার সন্নিকটে নেপালের হিলাম নামক এক জেলা আছে; সেই জেলায় গোরখা বাঙ্গানা নামে একটি বাজারের সন্ধান মেলে।

এরপর সেখানে অনুসন্ধান চালিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় তার বড়ভাইয়ের স্ত্রীকে (ভাবী)। তিনি ছবি দেখে নিশ্চিত করেন এই বীর কা বাহাদুর-ই তাঁর দেবর। বহুদিন আগে যিনি কাজের সন্ধানে বেরিয়ে আর ফেরেননি। এরই মাঝে তার বড়ভাইও মারা গেছেন। বাড়ির অন্য সদস্যদের বীর কা বাহাদুরের কথা তেমন মনে নেই। পরিবার তার পরিচয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হলে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এবিষয়ে অনুমোদন পাওয়ার পর তাকে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ   ঈশ্বরদীর সকল পূজা মণ্ডপে সিসি ক্যামেরা, প্রতিমার চূড়ান্ত সাজসজ্জা চলছে

তাঁকে ফিরিয়ে নিতে আসা নেপাল দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি উজানা বামজান বলেন, ‘বীর কা বাহাদুর রায় বাংলাদেশে ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে আছেন। এখন তিনি নেপালে ফেরার ইচ্ছা পোষন করেছেন। নেপাল সরকারের উদ্যোগে তাকে বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সীমান্তে তার পরিবারের সদস্যরা এসে তাকে গ্রহণ করবেন। তাঁকে দেশে ফেরার জন্য সহায়তা করায় আমি দুপচাঁচিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও দুপচাঁচিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সেইসাথে নেপাল দূতাবাসের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ করার কারণে দুপচাঁচিয়ার বাসিন্দা মেহেদী হাসান খান ফরেনের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।’

দুপচাঁচিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাত আরা তিথি বলেন, এদেশে আটকে পড়া নেপালী বংশধর বীর কা বাহাদুর তার দেশে ফিরতে চাওয়ায় দু’দেশের মধ্যে কাগজপত্র তৈরি হয়। সে মোতাবেক নেপাল দূতাবাস থেকে সেকেণ্ড সেক্রেটারিসহ একটি প্রতিনিধি দল বীর কা বাহাদুরকে নেওয়ার জন্য আসেন। আমরাও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাঁকে তুলে দেই। বৃহস্পতিবার(২৩ মে) বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে তাঁকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবেন নেপাল দূতাবাস।

এদিকে নিজ দেশে ফেরা নিয়ে চিরকুমার বীর কা-বাহাদুর বলেন, ‘ওরা বললো আমি নেপালে গিয়ে বাড়ির লোকজনের সাথে দেখা করে আবার ফিরে আসবো। এখান থেকে যেতে ভালো লাগছে না। নেপালে তো আমার কিছুই নেই। আমি আবার কয়দিন পর এখানে চলে আসবো।’ বলে চোখের কোণা দিয়ে জল ছেড়ে দেয়।

এদিকে বীর কা বাহাদুরের দেশে ফেরার কথা শুনে এলাকার অনেকেই ছুটে যান তার সাথে বিদায় সাক্ষাত করতে। এসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তারা। দীর্ঘদিন এলাকায় থেকে স্থানীয়দের আদর ও ভালোবাসা কুঁড়িয়েছেন বীর কা বাহাদুর। তিনি চলে যাওয়ার খবরে তাদের চোখ জলছল ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অনেকটাই শূন্যতার প্রতিচ্ছবি।