পার্বত্য জেলায় শান্তি কেড়ে নিয়েছে কেএনএফ, কঠোর পদক্ষেপ চান স্থানীয়রা

অনলাইন ডেস্ক : দেশের তিন পার্বত্য জেলায় আতঙ্কের নাম—‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ বা (কেএনএফ)। সম্প্রতি বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের তিনটি ব্রাঞ্চে নজিরবিহীন ডাকাতির ঘটনা ঘটায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি। এরপর থেকেই কেএনএফকে নিয়ে পাহাড়ে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

স্থানীয়রা জানান, সরকার-সেনাবাহিনীর চেষ্টায় বান্দরবানে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। তিন পাহাড়ি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শান্তিতে ছিলেন বান্দরবানবাসী। সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে জেলার রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িতে থমকে আছে সব উন্নয়ন কাজ।

সম্প্রতি ব্যাংক ডাকাতি ও থানায় হামলার ঘটনায় কেএনএফ—এর তাণ্ডব প্রকাশ্যে আসে। এর পর থেকে এসব এলাকায় চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও জানা গেছে।

এদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কেএনএফ-এর সঙ্গে আর শান্তি আলোচনার কোনো মানে হয় না। তারা শান্তি আলোচনার সব শর্ত ভঙ্গ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শান্তি আলোচনা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম একসঙ্গে চলতে পারে না। এখন সময় এসেছে কেএনএফকে শক্ত হাতে দমন করার।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুকি-চিনের অত্যাচারের কারণে রুমা ও থানচি এলাকার শত শত স্থানীয় বাসিন্দা আগে থেকেই ঘর ছাড়া। নতুন করে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে আবারও ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে অনেক পরিবার।

আমাদের অব্যাহত অভিযানের কারণে কেএনএফ অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে শান্তি আলোচনা চলাকালীন তারা আবারও রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন মুঠোফোনে রুমা উপজেলার ১নং পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লামং মার্মা বলেন, কেএনএফের কারণে রুমা উপজেলায় আগে থেকেই শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়ে আছে। তাদের অত্যাচারে অনেক আগে থেকেই ঘর ছাড়া অনেক মানুষ। এখন আবার নতুন করে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে ঘর ছেড়ে আরও মানুষ পালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কারণে আমি নিজেও এলাকা ছাড়া।

তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা করে কোনো লাভ হবে না। গত কয়েক দিনের ঘটনার পর মনে হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে এখন সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমার এলাকায় মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে কেএনএফ রুমা ও থানচির বিভিন্ন উপ-জাতি গোষ্ঠীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে আসছে। এছাড়া এসব এলাকায় কোনো ব্যবসা করতে গেলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে তারা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তখন মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। এবার তারা চাঁদাবাজির পাশাপাশি ব্যাংক লুটও শুরু করেছে।

কেএনএফ নিয়মিত পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। চাঁদাবাজিসহ অপহরণ কেএনএফের নিত্যদিনের কার্যক্রম। সর্বশেষ তারা রুমা ও থানচিতে ব্যাংক লুট করেছে এবং থানায় হামলা করেছে

আরও পড়ুনঃ   সাত দিনের মধ্যে ৪৪ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার নির্দেশ মাউশি'র

রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহ্লাঅং বলেন, কেএনএফের কারণে কথা বলতেও আমাদের এখন ভয় হয়। তারা বান্দবানের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। তাদের চাঁদাবাজির কারণে এলাকায় কেউ ব্যবসা করতে পারে না। টাকা না দিলে মারধর করে কিংবা অপহরণ করে। এখন তারা আবার ব্যাংক লুটে নেমেছে। দিন দিন তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কেএনএফ শুধু সন্ত্রাসী নয়, তারা পাহাড়ি কয়েকটি উপ-জাতি সম্প্রদায়কে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। তাই তাদেরকে সরকারের উচিৎ শক্তভাবে দমন করা। শ্রীলঙ্কার তামিল বাহিনীর মতো তাদেরও নির্মূল করতে হবে
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান

জেলার মানবাধিকার কর্মী উচিংমং মারমা  বলেন, কেএনএফের কারণে পাহাড়ি গ্রামের মানুষজন অনেক সমস্যায় আছে। নিয়মিত চাঁদাবাজির কারণে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ। তারা এত দিন চাঁদাবাজি করে সংগঠনের খরচ চালাতো। তারা এখন ব্যাংক লুট করা শুরু করেছে।

শ্রীলঙ্কার বিদ্রোহী সংগঠন তামিল টাইগারদের মতো কেএনএফকে দমন করা উচিত বলে মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান।

তিনি বলেন, কেএনএফ শুধু সন্ত্রাসী নয়, তারা পাহাড়ি কয়েকটি উপ-জাতি সম্প্রদায়কে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। তাই তাদেরকে সরকারের উচিত শক্তভাবে দমন করা। শ্রীলঙ্কার তামিল বাহিনীর মতো তাদেরও নির্মূল করতে হবে। তোষামোদ করে পৃথিবীর কোথাও শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি।

গত ২৬ বছর ধরে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো শান্তি আসেনি। সরকারের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার শক্ত হাতে তাদের দমন করার। সেনা সদস্যসহ পুলিশকে হত্যা করা হয়, ব্যাংক লুট করা হয় কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিবিদরা চুপ কেন। তাহলে তারা কি সন্ত্রাসীদের লালন করেন।

তিনি বলেন, কেএনএফকে দমনে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। পাহাড়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি আরও বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। সেনাবাহিনীকে ছাড়া পুলিশ কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর পক্ষে এসব অপ-তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। পাহাড়ের শান্তি শৃঙ্খলার জন্য সেনাবাহিনীর আরও ক্যাম্প প্রয়োজন।

কারা এই কেএনএফ
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কেএনএফের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ লেখা থাকলেও ২০১৮ সালে সংগঠনটির সন্ত্রাসী কার্যক্রম সবার নজরে আসে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে পাহাড়ে সংগঠনটির সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ভয়াবহতা বাড়তে থাকে। এর পর থেকে সংগঠনটির বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। সংগঠনটি পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক আয়তনের অঞ্চলকে নিয়ে বেআইনি ও মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে। তাদের এই কল্পিত মানচিত্রের তিন পাশে রয়েছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত। বান্দরবান পাহাড়ের বম, পাঙ্খুয়া, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং নামক ক্ষুদ্র ছয়টি জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠন হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। কেএনএফ প্রধানের নাম হলো নাথান বম।

আরও পড়ুনঃ   স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় স্কাউট আন্দোলনকে বেগবান করার আহ্বান

এদিকে র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তারা কেএনএফরের ১৭ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছেন। সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি রেখেছে র‍্যাব।

নাথান বম কে?
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান প্রধান হলেন নাথান বম। নাথান বম রুমা উপজেলার বম উপ-জাতি সম্প্রদায়ের। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র। রুমার এডেন পাড়ায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি বেসরকারি সংগঠনেরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

কোথায় আছেন নাথান বম?
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও এই সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা মিজোরাম ও মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করেন। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার সুবিধা নিয়ে দ্রুত নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেন। এছাড়া নাথান বম বেশিরভাগ সময় মিজোরামে থাকেন বলেও জানা গেছে।

কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে কেএনএফ ও জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে পাহাড়ে অভিযান শুরু হয়। অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলা ও গুপ্ত বোমা (আইইডি) বিস্ফোরণে অন্তত পাঁচ সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। এছাড়া কুকি সন্ত্রাসীদের অতর্কিত সশস্ত্র হামলায় তিনজন কর্মকর্তাসহ মোট ১১ সেনা সদস্য আহত হয়েছেন।

আরও জানা যায়, কেএনএফ নিয়মিত পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। চাঁদাবাজিসহ অপহরণ কেএনএফের নিত্যদিনের কার্যক্রম। সর্বশেষ তারা রুমা ও থানচিতে ব্যাংক লুট করেছে এবং থানায় হামলা করেছে।

বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের শাখার অপহৃত ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সকালে বান্দরবান জেলা পরিষদের কনফারেন্স রুমে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য নিশ্চিত করেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

এই সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, র‍্যাব এর আগেও সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) কার্যকলাপ শনাক্ত করে। তারা পাহাড়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে একটি সংগঠনকে টাকার বিনিময়ে অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। সে সময় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সকল সদস্য এবং কেএনএফের কিছু সদস্যকে আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হই।

তিনি বলেন, আমাদের অব্যাহত অভিযানের কারণে কেএনএফ অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে শান্তি আলোচনা চলাকালীন তারা আবারও রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

তিনি আরও বলেন, গতকাল দুপুর থেকে আমরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করি। সন্ধ্যায় আমরা তাকে উদ্ধার করি। আমাদের অভিযান এখনো চলমান আছে। যেহেতু পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র তাদের কাছে রয়ে গেছে। আমরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবো।