স্টাফ রিপোর্টার : গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পৃথক মামলায় দুজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত। পাবনা জেলা সদরের রামানন্দপুর গ্রামের মোকছেদ মোল্লার ছেলে কাউসার উদ্দিনকে (৪১) তিন বছর এবং পাবনার আমিনপুর থানার দূর্গাপুর দক্ষিণচর এলাকার আব্দুল বারিক মল্লিকের ছেলে সাগর আহম্মেদকে (২৫) এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, কাউসার উদ্দিন স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় তিনি এক কর্মকর্তার ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন অফিসিয়াল তথ্য অন্য ব্যক্তি ও অফিসে হস্তান্তর করেছিলেন। একইসঙ্গে অনুমতি ছাড়াই কোম্পানির রিসোর্স ব্যবহার করে অন্যদের কাছে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছিলেন।
অন্যদিকে, পারিবারিক বিরোধের জেরে এক তরুণীর আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন সাগর আহম্মেদ।
রাজশাহী বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত সূত্র মতে, শুধু এই দুটি ঘটনায় না, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক, অনলাইন, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম, হোয়াটস্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাজশাহী বিভাগে ব্যাপক হারে অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজশাহী বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের পাবলিক প্রশিকিউটার ইসমত আরা বলেন, ‘দুই বছর আগেও যেখানে গড়ে প্রতিদিন এক-দুটি মামলা আসতো এ আদালতে। এখন গড়ে অন্তত তিন-চারটি মামলা আসছে। প্রতিদিন এখন ৬-৭টি মামলা আদালতে উঠছে। সেই হারে সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। তবে আদালতের বিচক্ষণতায় মামলাজট তেমন নাই এখানে।’
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বি ৪০ বছর বয়স্ক এক নারীর ফেসবুক হ্যাক করে অশ্লিল ছবি ও ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয় সম্প্রতি। এ ঘটনায় ওই নারী নিজেই পাঁচবিবি থানায় গত বছরের ১২ মে একটি অভিযোগ করেন। এর পর মামলাটি তদন্তে পাঁচবিবি থানা রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) গঠিত সাইবার অপরাধ ইউনিটের সহযোগিতা কামনা করে। আরএমপির সাইবার ইউনিট অভিযোগটি পেয়ে সেটি ইংলিশে কনভার্ট করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। এরপর আমেরিকায় অবস্থিত ফেসবুকের প্রধান কার্যালয় হয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পায় আরএমপি’র সাইবার ইউনিট। সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতকে খুঁজে বের করে দেই সাইবার ইউনিট।
রাজশাহীর পবা এলাকার রাফসান জনি নামের এক শিক্ষার্থীর নিকট ফেসবুক হ্যাক করে অশ্লিল ছবি ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করে প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় জনি গত বছরের ৩১ মার্চ একটি অভিযোগ করেন নগরীর পবা থানায়। পরবর্তিতে আরএমপির সাইবার ইউনিট ঘটনাটি তদন্ত করে অভিযুক্তকে খুঁজে বের করেন।
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী সৌরভের বিকাশ নম্বর হ্যাক করে ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় একটি প্রতারক চক্র। এ ঘটনাটি নিয়ে সৌরভ মতিহার থানায় একটি অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের পরে আরএমপির সাইবার ইউনিট তদন্ত করে অভিযুক্তকে খুঁজে বের করে টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করে।
আরএমপির সাইবার ইউনিট সূত্র মতে, শুধু এসব ঘটনায় নয়, গত কয়েক বছরের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার অপরাধের পরিমাণ এখন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। সবচেয়ে বেশি অপরাধ হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। এর পরে আছে বিকাশ, নগদ ও রকেট হ্যাক করে প্রতারণা। গড়ে এখন আরএমপির সাইবার ইউনিটে রাজশাহীসহ আশে-পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৫-৭টি অপরাধের অভিযোগ আসে। যেগুলো তদন্ত করে আসামিকে খুঁজে বের করার কাজ করে থাকে সাইবার ইউনিট।
আরএমপির সাইবার ইউনিটের অপারেশনাল এক্সপার্ট (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) উৎপল কুমার বলেন, ‘সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত অপরাধ এখন বেড়েছে আগের চেয়ে। আর এ সমস্ত অপরাধের অধিকাংশ অপরাধী থাকে আড়ালে। মূলত সেসব অপরাধীকে চিহ্নিত করে দেওয়ায় হলো আমাদের কাজ। আর এ কাজটি করতে আমাদের কয়েকটি ধাপ পের হতে হয় অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে। কারণ এ ধরনের অপরাধ যেমন বাড়ছে, তেমনি অপরাধীরাও অতিরিক্ত গোপন কৌশল ব্যবহার করছে।’
তিনি জানান, ‘গত বছর আরএমপির সাইবার ইউনিটে তিন হাজার ২৪৪টি। এর মধ্যে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ ছিল ৮৮৮টি। সেগুলোর মধ্যে অনলাইন, ফেসবুক, ইমো, হোয়াটস্যাপ, ইমেইলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ আসে ৫০৭টি। সেগুলোর মধ্যে সাইবার ইউনিট ৪৮৫টি অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করে। এছাড়া নগদ, বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আসে ৩৮১টি। তার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন হয় ৩৫৭টির। ২০২২ সালে এ ইউনিটে অভিযোগ জমা হয় ৩৬৮৩টি। এর মধ্যে সাইবার সংক্রান্ত অভিযোগ জমা হয় ৭৮০টি। এসব অভিযোগের মধ্যে ফেসবুক, অনলাইন, ইমো, হোয়াটস্যাপ, ইমেইলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ আসে ৪৪৭টি। আর নগদ, বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ আসে ৩৩৩টি। আনুপাতিক হারে ২০২২ সালের চেয়ে ২০২৩ সালে সাইবার অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি চলতি বছরের গত জানুয়ারি মাসে অভিযোগ জমা পড়েছে ১৫০টির মতো। যা গড়ে প্রতিদিন ৫-৬টি করে অভিযোগ আসছে। সেই হিসেবে ২০২২ ও ২০২৩ সালের চেয়ে চলতি বছরে এই ধরনের অপরাধ রাজশাহী বিভাগে বেড়েছে আরও বেশি।
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি এমটিএফ নামে অনলাইনের মাধ্যমে প্রতারণা করে একটি চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় কয়েকটি অভিযোগ এবং ইউএস এগ্রিমেন্ট নামের আরেকটি চক্র প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় একটি অভিযোগও তদন্ত করছে আরএমপির সাইবার অপরাধ ইউনিট।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি আনিসুর রহমান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিভাগে যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তার মধ্যে বেশি অপরাধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাইবার অপরাধ। বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে বা অনলাইনে প্রতারণা বেড়েছে ব্যাপক হারে। তবে পুলিশের তদন্তকারী দল এখন এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও জোর তৎপর রয়েছে।’