অনলাইন ডেস্ক : লর্ড। শব্দগত অর্থ দেখলে বিশালত্বের প্রতিফলন থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘লর্ড’ শব্দটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিংবা চূড়ান্ত নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছোঁয়ায় দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে এই শব্দের ব্যাপক ব্যবহার। এই ‘লর্ড’ বিশেষ একজন খেলোয়াড় নন, তালিকাটা বেশ লম্বা। তবে একটা জায়গা পরিষ্কার- শুধু ব্যাটারদেরই এই নামে ডেকে থাকেন নেটিজেনরা।
প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মিল ঘটাতে না পারলেই সেই ব্যাটারকে আক্রমণ করা হচ্ছে এই নামে। যে তালিকায় ছিলেন নাজমুল হোসেন শান্তও। এখন হয়তো পুরোপুরি নাম কাটা যায়নি তার। তবে দেশের জার্সিতে সাম্প্রতিক ফর্ম ও নেতৃত্ব পাওয়ায় শান্তর ওপর থেকে সরতে শুরু করেছে সমালোচকদের চোখ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পর তো চারদিক থেকে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন তিনি।
কিছুদিন আগেও যার দলে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেই শান্তর কাঁধে এখন বাংলাদেশের দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব যে তার ওপর চাপ তৈরি করেনি, সেটি সমালোচকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন অসাধারণ সেঞ্চুরিতে। নিন্দুকদেরও ভালোবাসা পাচ্ছেন এখন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন একজন লিখেছেন, “আর লর্ড নয়। শান্ত তুমি ক্লাস। অসাধারণ।”
সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল শান্তর। সেটা ছিল অস্থায়ী। তবে শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে স্থায়ী অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন তিনি। সেই শুরুটা কী চমৎকারভাবে রাঙিয়ে নিলেন। বিপর্যস্ত দলকে টেনে তুলে সত্যিকার অধিনায়কের মতো নেতৃত্ব দিলেন সামনে থেকে। অপরাজিত ১২২ রানে অধিনায়ক ক্যারিয়ারের ‘অভিষেক’ রাঙালেন বাঁহাতি ব্যাটার।
অথচ খুব বেশি আগের কথা নয়। এবারের বিপিএলে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স ছিল তার। ফরম্যাট যদিও আলাদা, তারপরও সিলেট স্ট্রাইকার্সের জার্সিতে তার ফর্মহীনতা দুশিন্তার মেঘ জমায়। কুড়ি ওভারের প্রতিযোগিতায় কিছুই করতে পারেনি শান্ত। এর মাঝেই পান বাংলাদেশ দলের পূর্ণকালীন অধিনায়ক হওয়ার খবর। সাকিবকে সরিয়ে তিন ফরম্যাটে অধিনায়ক করা হয়েছে শান্তকে। এই নতুন পথচলা তার শুরু হয়েছে শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে।
বিপিএলে রান না পেলেও কুড়ি ওভারের ফরম্যাটে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতেই শান্তর বাজিমাত। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে খেলেন ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৫৩ রানের ইনিংস। এবার ওয়ানডে সিরিজ শুরুই করলেন সেঞ্চুরিতে। তাও আবার স্থায়ী অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবার নেমেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আর কোনও অধিনায়কের যে কীর্তি নেই।
এখানেই শেষ নয়। প্রথম সেঞ্চুরিতেই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন অধিনায়ক শান্ত। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ইনিংস এখন তার। ভেঙেছেন মুশফিকুর রহিমের আগের রেকর্ড। ২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ১১৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তখনকার অধিনায়ক মুশফিক।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে সম্ভাবনার কথা জানান দিয়েছিলেন শান্ত। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) নজরে রেখেছিল এই ক্রিকেটারকে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে পরিচর্চার পর যখন জাতীয় দলে ডাকা হয়, তখন থেকেই আগামীর জন্য তাকে তৈরি করার চেষ্টা চলে। সেকারণে বারবার ব্যর্থ হলেও তাকে দলে রেখেছে কিংবা ডেকেছে টিম ম্যানেজমেন্ট।
বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের একাংশ বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। বিসিবির ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ শান্তকে নিয়ে ট্রল শুরু হয়। ‘লর্ড’ জুড়ে যার তার নামের সঙ্গে। ওয়ানডে ক্রিকেটে তার প্রথম দিকের পারফরম্যান্সে চোখ রাখলে এই সমালোচনা বাড়াবাড়ি মনে হবে না হয়তো। কারণ ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ৬ ইনিংসে মাত্র একবারই দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পেরেছিলেন শান্ত। সেই স্কোরও ছিল মাত্র ২৯ রানের। পরিসংখ্যানটা আরেকটু বড় করলে দেখা যায়, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে প্রথম হাফসেঞ্চুরির জন্য তাকে খেলতে হয়েছে ১৬ ইনিংস! ২০১৮ সালে অভিষেকের পর ফিফটি পেতে তার লাগে প্রায় পাঁচ বছর।
তবে গত বছর থেকে বদলাতে থাকে শান্তর পারফরম্যান্স। আলো ছড়াতে থাকে তার ব্যাট। ক্যারিয়ারের প্রথম হাফসেঞ্চুরি তিনি পেয়েছেন ২০২৩ সালের মার্চে। প্রথম সেঞ্চুরি পেয়ে যান দুই মাস পরই। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১১৭ রানের ইনিংস। তবে বর্তমান শান্তর ‘শুরুর’ কথা বললে আসবে গত বছরের এশিয়া কাপের কথা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮৯ রানের পর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৪ রানের ইনিংস।
এরপর ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও তার ব্যাট থেকে আসে ৭৬ রানের ইনিংস। ভারতের বিশ্বকাপ অবশ্য খুব একটা ভালো কাটেনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯০ ও আফগানিস্তানের সঙ্গে অপরাজিত ৫৯ রান বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং ‘হাইলাইট’। সেই শান্তর ম্যাজিক আরেকবার দেখা মিলল চট্টগ্রামে, ম্যাচজেতানো সেঞ্চুরিতে।
আরেকটি বিষয় হলো, শান্তর রান পাওয়া বেশিরভাগ ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। তার প্রথম সেঞ্চুরির কথা বলা যায়। আয়ারল্যান্ডের ৩২০ রানের লক্ষ্যও সেদিন পেরিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পথে শান্তর ব্যাট থেকে এসেছিল ১০৪ রানের ইনিংস। এছাড়া বিশ্বকাপে এই আফগানদের হারানো কিংবা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়-দুটোতেই হেসেছিল শান্তর ব্যাট।
তার নাম অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণার পর তাই অনেকের মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল- নেতৃত্বের চাপ যদি শান্তর ব্যাটিংয়ের ওপর পড়ে! পূর্ণকালীন অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম ম্যাচে নেমেই সব সন্দেহ-সংশয় দূর করে দিলেন এই ক্রিকেটার। দেখিয়ে দিলেন, নেতৃত্বের দায়িত্ব বরং তাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে ভালো খেলার।
চাপে চ্যাপ্টা না হয়ে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সাহসিকতা ফুটে ওঠেছে তার ব্যাটিংয়ে। বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি কিংবা একই ঢংয়ে জয় নিশ্চিতে শান্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার প্রয়োজনীয়তার কথা। ‘লর্ড’ অপবাদে যতই নিন্দুকেরা আক্রমণ করুক না কেন, তিনি নিজের পথে অবিচল। নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে শান্ত এখন ‘কিং’।